প্রতিনিধি ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ , ৬:১২:৩৯ অনলাইন সংস্করণ
শাল্লা প্রতিনিধি: ২০১৭ সালের অকাল বন্যায় হাওর তলিয়ে যাওয়ার পর কপাল খুলে যায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের। আর এই সুযোগে আঙ্গুল পুলে কলা গাছ হয়ে যান শাল্লার সাবেক এসও (উপ সহকারি প্রকৌশলী) শমসের আলী মন্টু। ২০১৭ সালের অনাকাঙ্খিত ঘটনার পর সরকার হাওরপাড়ের কৃষকদের ফসল রক্ষার জন্য নতুন নীতিমালা প্রনয়ন করেন। এই নীতিমালা অনুয়ায়ী তৈরি করা হয় পিআইসি। প্রকৃত কৃষকদের মাধ্যমে পিআইসি(প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) গঠন করে হাওরের বাঁধের কাজ করার কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু নীতিমালা প্রনয়ন করা হলেও বাস্তবে ভিন্ন রুপ। কৃষকদের নামে হাওর রক্ষা বাঁধের কাজে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ আসলেও এসব বরাদ্দ ভাগবাটোয়ারায় ব্যস্ত সিন্ডিকেট চক্র। আর এই চক্রের সাথে যোগসাজস ছিল সাবেক কর্মকর্তা এসও শমসের আলী মন্টুর। তিনি ২০১৮ সাল থেকে শাল্লায় যোগদান করার পর গঠন করেন একটি সিন্ডিকেট চক্র। আর এসব চক্রের সদস্যদের দ্বারা পিআইসি গঠন থেকে শুরু করে বিল উত্তোলনের ভাটোয়ারায় অংশীদারিত্ব ছিলেন। আর এসব কিছু নিয়ন্ত্রনে স্থানীয় এক ব্যক্তিগত সহকারি নিয়োগ দেন। এই সহকারির মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে পিআইসি গঠন করতেন। এছাড়াও পিআইসির সদস্যরা প্রথম বিল থেকে শুরু করে চতুর্থ বিল উত্তোলনের সময়ও এসও শমসের আলীকে ভাটোয়ারা দিতে হত। প্রতি বছরের মত এবছরও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পিআইসি বন্টন করেছেন। এছাড়াও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পকে প্রয়োজনীয় বলে অনুমোদনও দিয়েছেন। শুধু তাই নয় টাকার বিনিময়ে বরাদ্দও বেশি বেশি দিয়েছেন। কোনো কোনো পিআইসি টাকা না দেওয়ায় বরাদ্দও কম পেয়েছে। এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে শমসের আলী মন্টুর বিরুদ্ধে। তবে বাঁধ নির্মাণে আগের ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে পিআইসি গঠন করায় লুটপাটের মহোৎসব বৃদ্ধি পেয়েছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে না নিয়ে প্রকৃত কৃষকদের দ্বারা পিআইসি গঠন করা হলে হাওরের ফসল রক্ষার বাঁধ নির্মাণ সঠিকভাবে হত বলে মনে করেন সচেতন মহল। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে শাল্লায় ১৩৭টি হাওর রক্ষা বাঁধের নামে ২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ আসে। প্রকল্প অনুমোদন থেকে শুরু করে ওয়ার্ক অর্ডার পর্যন্ত শাল্লার দায়িত্বে ছিলেন এসও শমসের আলী। এর মধ্যে জানতে পারেন শমসের আলীকে দোয়ারাবাজারে বদলী করা হবে। সেই সুযোগে টাকার বিনিময়ে বেশির ভাগ প্রকল্পেই বরাদ্দের পরিমান বাড়িয়ে গেছেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে গত বছরের বাঁধ অক্ষত থাকলেও এবছর ২৪০ মিটারে ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। আবার কোনো কোনো ক্লোজারে ৬০০ মিটারে বরাদ্দের পরিমান ১০ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। অর্থ্যাৎ টাকা দিতে পারেনি বলে বরাদ্দের পরিমানও বাড়াতে পারেনি কিছু কিছু পিআইসির লোকেরা।
পাউবো’র সুত্রে জানা যায়, বরাম হাওরের উপ-প্রকল্প ১৪ এর সভাপতি প্রানেশ চন্দ্র দাসের বাঁধে ১৯৮ মিটারে ১৬ লাখ ১১ হাজার ৬৪ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অথচ এই বাঁধটি গত বছরের অক্ষত ছিল। আবার একই হাওরের উপ-প্রকল্প ১৩ এর বরাদ্দ ৫১৬ মিটারে ১৬ লাখ ১৬ হাজার ৭শ ২৭ টাকা দেয়া হয়েছে। এই দুই বাঁধের কাজ একই রকম। আবার উপ-প্রকল্প ১৫ এর সভাপতি গুনেন্দ্র চন্দ্র দাসের ১৯৭ মিটারে বরাদ্দের পরিমান ১৬ লাখ ৫৯ হাজার ১শ ৯৬ টাকা দেয়া হয়েছে। এই বাঁধটিও গত বছরের অক্ষত ছিল। শুধু এখানেই থেমে নয়, ভান্ডারবিল উপ- প্রকল্প ১৯ এর ২৩৩ মিটারে বরাদ্দের পরিমান ১৭ লাখ ৮১ হাজার ৩ টাকা। এই বঁাধটি একজন রাজনৈতিক নেতার ছত্রছাঁয়ায়। যার ফলে বরাদ্দের পরিমানও বেশি। শুধু তাই নয় এ বাঁধে নীতিমালার তোয়াক্কা না করে দায়সাড়া ভাবে কাজ করছেন প্রকল্পের সভাপতি গনেশ দাস। যেখানে ২ ফুট পর পর দুরমুজ করার কথা রয়েছে সেখানে এসব কিছু না করেই তড়িগড়ি করে বাঁধের কাজ শেষের দিকে নেয়া হয়েছে। একই হাওরের ২৩ নং উপ-প্রকল্পে ২৪০মিটারে বরাদ্দের পরিমান ২০ লাখ ৫৩ হাজার ১শ ৬৪ টাকা। স্থানীয়দের মন্তব্য এ বাঁধে এত বরাদ্দের প্রয়োজন ছিল না। তবে প্রকল্পের সভাপতি অভিনয় দাস নিময়নীতির তোয়াক্কা না করেই বাঁধের কাজ করছেন। এদিকে উপ প্রকল্প ২৭ এর পুরো বাঁধই গত বছরের অক্ষত ছিল। তবে স্থানীয় এক সাংবাদিকের মুখ বন্ধ করতে এই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৯ লাখ ৬৬ হাজার ৬৪ টাকা। অথচ এই সাংবাদিকের ভাই বাহাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা হয়ে কাজ করছেন হবিবপুর ইউনিয়নে। ভেড়াডহর হাওরে ৪১ নং প্রকল্পটি অপ্রয়োজনীয়। এই অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৮ লাখ ৫৪ হাজার ৮শ ৮১ টাকা। এই বাঁধের সভাপতি নরেশ অধিকারীর সাথে এসও শমসের আলীর সুসম্পর্ক থাকায় অপ্রয়োজনীয় বাঁধটি প্রয়োজনীয় বলে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এদিকে ছায়ার হাওরের ৯৮ নং প্রকল্পের সভাপতি প্রদ্যুৎ দাস। তিনি উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা বিধুর দাসের ভাই হওয়ায় প্রকল্প এলাকায় জমি না থাকা সত্ত্বেও সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। এই বাঁধটিও অপ্রয়োজনীয় ছিল। অথচ ৪৮০ মিটারে বরাদ্দ ১৫ লাখ ১৩ হাজার ১শ ৪৩ টাকা দেয়া হয়েছে। উপজেলাজুড়ে সকল হাওরেই বরাদ্দের পরিমান একটায় বেশি অন্যটায় কম হওয়ায় রহস্যজনক ঘটনা তৈরি করেছেন এসও মন্টু। উপজেলার কান্দিগাও গ্রামের কৃষক ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ সভাপতি আব্দুস সাত্তার মিয়া বলেন, রক্ষক যেখানে ভক্ষন সেখানে আমরা সাধারণ কৃষক কি করবো? হাওরের বরাদ্দের নামে হরিরলুট চলে। প্রকৃত কৃষকদের পিআইসি না দিয়ে এসও’র মনোনীত ব্যাক্তিদেরকে পিআইসি দেয়া হয়েছে। আর টাকার বিনিময়ে পিআইসিদের বরাদ্দের পরিমানও বাড়িয়ে দিয়েছেন এসও শমসের আলী মন্টু।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিআইসির এক সভাপতি বলেন, উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা আমাদেরকে শুধু নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করার কথা বলেন। আমরা নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করার সুযোগই থাকে না। যেখানে বরাদ্দ দেয়া হয় ১২ লাখ টাকা সেখানে ভাটোয়ারা দিতে দিতে বরাদ্দের পরিমান চলে আসে ৮ লাখ টাকা। পিআইসি গঠন করার সময় এসও কে দেওয়া লাগে এক লাখ টাকা। এরপর প্রতিটি বিল উত্তোলনের সময় ৫০ হাজার করে দিতে হয়। না হলে বিল উত্তোলন বন্ধ করে দেয়। এধরনের চলতে থাকলে কোনো পিআইসির লোকেরাই সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না।
এ বিষয়ে শাল্লার সাবেক উপ সহকারি প্রকৌশলী শমসের আলী মন্টুর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও বক্তব্য দেয়া সম্ভব হয়নি। কারন তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এব্যপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (পওর-২) শফিকুল ইসলাম বলেন, শাল্লার হাওরের এসব বিষয়গুলো নিয়ে জেলা প্রশাসকের মতবিনিময়ে মন্ত্রী মহোদয়ের সামনে স্থানীয় সাংবদিকরা তুলে ধরেছেন। এসব বিষয়গুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর যেগুলো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প তা চিহ্নিত করে বাতিল করা হবে। তবে লিখিত অভিযোগ পেলে আমাদের ব্যবস্থা নিতে সহজতর হবে।