এলবার্ট পি. কষ্টা ২০ অক্টোবর ২০২৪ , ৩:৩৫:৩১ অনলাইন সংস্করণ
সংখ্যালঘু রাজনীতি বা রাজনীতিতে সংখ্যালঘুর ব্যবহার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি দগদগে ঘায়ের সৃষ্টি করেছে।
এই ঘায়ের চিকিৎসায় এর ইতিহাস ও গতি-প্রকৃতি পর্যালোচনা করা জরুরি। এ ঘা থেকে কারা কিভাবে লাভবান হয়েছেন বা হচ্ছেন; তা বুঝতে না পারলে অন্তরালে রয়ে যাবে অনেক প্রশ্নের উত্তর। নির্ধারণ করা যাবে না আগামী দিনের কর্মকৌশল।
উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমনের মাধ্যমে মুসলিম শাসনের পতন হলে স্বাভাবিক কারণে মুসলিমরা সর্বপ্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনে মনোযোগী হন। ইংরেজদের প্রত্যাখ্যান ও প্রতিহতের মাধ্যমে এই সংগ্রামের সূত্রপাত।
পক্ষান্তরে তৎকালীন বৃহৎ জনগোষ্ঠী হিন্দুরা ইংরেজদের সানন্দে বরণ করে নিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে মনোনিবেশ করেন। বিপত্তি বাধে ১৮৫৭ সালের সেপাহি বিদ্রোহে। এ বিদ্রোহ হলো সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতিতে সংঘটিত সর্বশেষ লড়াই। এ লড়াই থেকে ঔপনিবেশিক শাসকরা নিশ্চিত হন যে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তাদের জন্য কতটা ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে। ফলে ঔপনিবেশিক শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় জন্ম হয় সংখ্যালঘু নামে এক দগদগে ঘায়ের। ফলস্বরূপ ঔপনিবেশিক শাসন দীর্ঘ হতে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী। এমনকি সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে উপমহাদেশে জন্ম নেয় দু’টি দেশ।
পাকিস্তান আমলের শুরুতে শাসকরা পাকিস্তান চেতনার মূল ভিত্তি অর্থাৎ ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামো থেকে সরে আসায় এখানে উদ্ভব ঘটে এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার। পক্ষান্তরে, বৃহত্তর রাষ্ট্র্র ভারত ছলে বলে কৌশলে রাষ্ট্র সংহতি স্থাপনের নামে হায়দরাবাদ, কাশ্মির, জুনানগর প্রভৃতি দেশীয় রাজ্য দখলের মাধ্যমে আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। পূর্বপাকিস্তানে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় হাওয়া দিতে থাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারা। আধিপত্যবাদী শক্তির হস্তক্ষেপে যৌত্তিক অযৌক্তিক ভয়, লোভ ইত্যাদি বা প্রলোভনের ফাঁদে প্রায় সব সংখ্যালঘু এ ধারায় যুক্ত হয়ে একে শক্তিশালী রূপ দান করেন। যদিও সংখ্যাগুরুরা ছিলেন দ্বিধাবিভক্ত। তাদের একটি বড় অংশ রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে এর রি-কনসিলেশনের পক্ষে থেকে যান। ফলে চূড়ান্ত সংঘর্ষের সময় যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সেটি আসলে ততদিনে সংখ্যালঘু স¤প্রদায় নয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠায় রাজনৈতিক কারণে সংগঠিত হয়। এখান থেকে শুরু সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক সমস্যার।
স্বাধীন বাংলাদেশের শুরু থেকে আধিপত্যবাদী ভারত স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী হিসাবে আওয়ামী লীগকে একক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালায়। এই দলটিকে ভারত একমাত্র বন্ধু ও দোসর বানিয়ে ফেলে। সেই সাথে সব সংখ্যালঘুকে দলটি নিজের ছাউনিতে সমবেত রাখতে সক্ষম হয়।
কিন্তু আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত থাকার সুবাদে তাদের প্রতি হয়ে পড়ে উদাসীন। শুধু তাই নয় সংখ্যালঘুদের প্রতি নির্যাতন চালানোর যেন লাইসেন্স পেয়ে যায়। যুদ্ধের সময় বিপুলসংখ্যক সংখ্যালঘু ভারতে আশ্রয় নেয়ায় পাকিস্তান সরকার তাদের ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত করলেও স্বাধীতার পরে তা তাদের ফেরত না দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে লিজের মাধ্যমে তা দখলে নেয়।
বাংলাদেশের দীর্ঘ ৫৩ বছরের ইতিহাসে প্রকৃত অর্থে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে হাতেগোনা। এসব দাঙ্গায় কিছু ভাঙচুর ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। দখল বা উচ্ছেদ সংঘটিত হয়নি। দখল উচ্ছেদ বা নির্যাতনের মতো ঘটনাগুলো প্রধানত ঘটে একটি সুর্নিদিষ্ট রাজনৈতিক কারণে। বিশেষ করে বিগত সময়ে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হয়। এর কারণ বেশির ভাগ সংখ্যালঘু কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। ফলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যখন আক্রমণের স্বীকার হয়; তখন তাদের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু লোক স্বাভাবিকভাবে থাকে।
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার আদায়ে যে সংগঠনটি করা হয়েছে তাতে সবধর্মের প্রতিনিধি থাকলেও সংখ্যাগুরু স¤প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নেই। অথচ তারা সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার। তার ওপর এ সংগঠনের সবাই কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত। সুবিধাভোগী। এমনও শোনা যায়, এদের কিছু ব্যক্তি পার্শ্ববর্তী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন।
এসব জটিলতা, রাজনৈতিক আইডেনটিটি ও প্রোপাগান্ডার মাঝে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় হলো সংখ্যালঘুর সংখ্যালঘুরা। অর্থাৎ খ্রিষ্টান, বৌদ্ধসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের লোক, যারা মূলত সংখ্যালঘুর সংখ্যালঘু। তাদের বেশির ভাগ মানুষ নির্দলীয় হওয়ায় আধিপত্যবাদী শক্তি ও তাদের দোসররা নানা ভয়ভীতি ও নির্যাতনের মাধ্যমে একটি দলীয় আইডেনটিটি নিশ্চিত করতে বদ্ধ পরিকর। ফলে পাহাড়ে অশান্তির খানিকটা বা রামুর মতো ঘটনাবলি সংঘটিত হয়।
সারা দেশে এদের ভয়াবহ নির্যাতনের বিষয়টি আমাদের সামনে এসেছে বারবার। উদাহরণস্বরূপ গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লীর ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামে সাঁওতালদের ওপর ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতৃত্বে পুলিশের উপস্থিতিতে এক বীভৎস নারকীয় তাণ্ডব চালানো হয়। যেখানে পুলিশের গুলিতে তিনজন নিহত ও বেশ কয়েক জন গুরুতর আহত হন।
সুগার মিলের বাগদা ফার্মের জমি-জমা ঘিরে আদিবাসীদের ওপর এ নারকীয় তাণ্ডব চলে। সরকারি ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগ সাঁওতালদের জমিজমা ও বাস্তু ভিটা থেকে তাদের উচ্ছেদ করে যাদের বেশির ভাগ খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী। সংখ্যালঘু অধিকার আদায়ের কোনো সংগঠন সেদিন এগিয়ে আসেনি ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় সাঁওতালদের রক্ষায়। এরকম অনেক ঘটনা উল্লেখ করা যায়।
১৯৭৪ সালের খ্রিষ্টানদের প্রতিষ্ঠান নটর ডেম কলেজের হোস্টেল বিল্ডিংয়ে হামলা, ১৯৯৬ সালে লক্ষ্মীবাজারস্থ সেন্ট জোভিয়ার চার্চের সম্পত্তি দখলের চেষ্টা, ২০০১ সালে বানিয়ারচর গির্জায় বোমা হামলায় ১০ জন নিহত, ২০১৬ সালে নাটোরে সুনীল গোমেজ হত্যা, ২০১৬ সালে রাজশাহীর বনপাড়ার খ্রিষ্টান পল্লীতে হামলা ইত্যাদি ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে আওয়ামী লীগ আমলের। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত ২০২১ সালে অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগের ৯ বছরে অন্তত তিন হাজার হামলা হয়েছে হিন্দুদের ওপর। প্রকৃত হামলার পরিসংখ্যান আরো দীর্ঘ। অথচ রানা দাশগুপ্তরা কোনো এক অজানা কারণে উল্লিখিত কোনো হামলার বিপক্ষে কার্যকর প্রতিরোধে ভ‚মিকা রাখতে পারেননি।
পরিশেষে আজ মহান জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিপক্ষে। ২০২৪ সালে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি আধিপত্যবাদী দিল্লি ও তাদের এদেশীয় ফ্যাসিস্ট দোসরদের হাত থেকে। চারদিকে এখন রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও বিনির্মাণের ডাক। তাই আমাদের ভাবতে হবে আমরা আর এদেশে সংখ্যালঘু অথবা সংখ্যালঘুর সংখ্যালঘু হিসেবে বসবাস করতে চাই না। আমরা বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক। আমাদের একটাই পরিচয়, আমরা বাংলাদেশী।
চব্বিশের বিপ্লবে আমাদের সম্প্রদায়ের আত্মহতি গর্বিত করে তোলে আমাদের। আমরা আর কোনো আইডেন্টিটি রাজনীতির ফাঁদে পড়ে ফ্যাসিবাদের সহযোগী হতে চাই না। অধিকার ও নিরাপত্তা আদায়ের প্রশ্নে অবশ্যই আমাদের রাষ্ট্রের পাশাপাশি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সাথে গভীর যোগাযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তাদের মনে করিয়ে দিতে হবে তাদের ধর্মীয় অনুশাসন। তাদের মনে করিয়ে দিতে হবে বৃহত্তর সম্প্রদায়ের প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের অধিকার ও নিরাপত্তার দায় তাদের। এ লক্ষ্যে তাদের সাথে বৃহৎ যোগাযোগ ও নিবিড় ঐক্য আমাদের অধিকার ও নিরাপত্তার চাবিকাঠি।
দ্বিতীয় স্বাধীনতার পর সংখ্যালঘুদের স্থাপনা পাহারায় সংখ্যাগুরু সপ্রদায়ের আন্তরিক প্রচেষ্টার এই বৃহৎ ঐক্য আমাদের আশাবাদী করে। কোনো রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ এ ঐক্যকে যেন বিনষ্ট করতে না পারে এটা আজকের দিনে আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
লেখক : রাজনীতিক ও সভাপতি বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশন, জাতীয় নির্বাহী কমিটি
সূত্রঃ নয়াদিগন্ত।