ভাটি বাংলা ডেস্ক: ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ২:১৫:১৬ অনলাইন সংস্করণ
ঘটনা ৫ আগস্ট বিকেলের। সরকার প্রধান শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। গোটা দেশে তখন বিজয় উল্লাস। কিন্তু তখনও থেমে ছিল না দলকানা কতিপয় পুলিশের উন্মত্ততা।
সেদিনও গা শিউরে ওঠা নিষ্ঠুর ঘটনাটি ছিলো আশুলিয়া থানায়। পুলিশের কিছু সদস্য যেন দানবে পরিণত হয়ে উঠেছিল। নিজেদের রাম রাজত্বের শেষ পরিণতি জেনেও আনন্দ মিছিলের ওপর তখনও বৃষ্টির মতো গুলি করে এসব পুলিশ। হাসিনার পালিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে ৪৬ জন নিহত হন।
গুর্লিবিদ্ধ হন কয়েকশ’ আন্দোলনকারী। আশুলিয়া থানা সড়কটি ছিলো যেন যুদ্ধক্ষেত্র। এরই মাঝে গুলিবিদ্ধদের মধ্যে নিহত কয়েকজনের লাশ থানায় রক্ষিত ভ্যানে তুলে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে পুলিশ। মানুষ তা জানতে পারে অজ্ঞাত ব্যক্তির প্রকাশ করা ১৪ সেকেন্ডের ভিডিওর মাধ্যমে। ফুটে ওঠে আশুলিয়া থানা পুলিশের নৃশংসতার চিত্র। এসব ঘটনায় জড়িতদের কয়েকজন পলাতক থাকলেও অনেকেই রয়েছেন একই থানার দায়িত্বে। কারো কারো হয়েছে প্রমোশন।
আশুলিয়ায় আন্দোলনরত ৪৬ জনকে গুলি করে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী, ২১ পুলিশ সদস্যসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ৩৬ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় মানারত ইউনিভার্সিটির ইইই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র নিহত আহনাফ আবীর আশরাফুল্লাহর বোন সাইয়েদা আক্তারের পক্ষে গত বৃহস্পতিবার আবেদনটি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ান।
লাশ পোড়ানো এবং পুলিশের গুলিতে হতাহতের সব ঘটনার নেপথ্যের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন তখনকার দায়িত্বে থাকা ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আব্দুল্লাহিল কাফি (ক্রাইম অ্যান্ড অবস), ঢাকা জেলা উত্তরের ডিবি পরিদর্শক আরাফাত হোসেন, আশুলিয়া থানার ওসি এএফএম সায়েদ আহমেদ, ওসি (অপারেশন) নির্মল চন্দ্র দাস, ওসি (তদন্ত) মাসুদুর রহমান, এসআই অমিতাভ চৌধুরী, এসআই অপূর্ব সাহা, এএসআই সুমন চন্দ্র গাইন, এএসআই বিশ্বজিৎ রায়, রিজার্ভ পুলিশের এসআই শিব সঙ্কর, এসআই জলিল, এসআই মো. রাকিবুল, এসআই আবুল হাসান, এসআই হামিদুর রহমান, এসআই নাসির উদ্দিন, এসআই আব্দুল মালেক, কনস্টেবল মুকুল, কনস্টেবল রেজাউল করিমসহ কতিপয় পুলিশ সদস্য। যাদের অনেকেই পেছনের এবং পারিবারিক ইতিহাস বলছে, তারা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা আ’লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
সরকার বদল হয়েছে কিন্তু এখনও একই থানায় রয়ে গেছেন অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের অনেকেই। যে কারণে স্থানীয়দের মধ্যে এখনো আতঙ্ক কাটছে না। গতকাল রোববার স্থানীয়দের সঙ্গে ৫ আগস্ট ও এর আগের দিনের ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থানীয়রা প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস পাননি।
গতকাল বেলা ১১টায় আশুলিয়া থানায় গিয়ে দেখা যায়, ওসির চেয়ারে বসে আছেন রাজবাড়ি এলাকার পুলিশের একজন পরিদর্শক। তার পাশের নিচু চেয়ারে বসে আছেন ওসি (অপারেশন) নির্মল চন্দ্র। পেশায় সিনিয়র বিধায় নির্মলের পক্ষে তাকে এ সম্মান প্রদর্শন বলে জানান তিনি।
ওসি প্রশাসন কোথায় জানতে চাইলে নির্মল বলেন, গত ১৮ আগস্ট ওসি এএফএম সায়েদ আহমেদকে বদলি করা হয়েছে। বর্তমানে ওসির দায়িত্বে রয়েছেন মাসুদুর রহমান। তাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
গত ৫ আগস্টসহ আগে পরের বিভিন্ন মামলা ও অভিযোগ প্রসঙ্গে নির্মল চন্দ্র ইনকিলাবকে বলেন, ৫ আগস্টের দিন ও তার আগে থানায় কর্মকর্তাসহ পুলিশের মোট সদস্য ছিলো ১৪০ জন। গতকাল রোববার থানায় মোট স্টাফ ছিলেন ৯০ জন। এই ৫০ জন পুলিশ সদস্যের অনুপস্থিতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবাই বদলি হয়ে গেছে।
তিনি আরো জানান, লাশ পোড়ানো, নিহত আহতসহ সহিংসতার ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত মোট ১৮টি মামলা হয়েছে আশুলিয়া থানায়।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীরা জানিয়েছেন, ওসি (অপারেশন) নির্মল চন্দ্র দাস দীর্ঘদিন ধরেই একই থানায় অবস্থান করছেন। আন্দোলন চলাকালে তার আচরণ ছিলো অপেশাদার।
রোড মার্চ টু ঢাকার আন্দোলন দমাতে তিনি গুলি বর্ষণ করেছেন নিরীহদের ওপর।
অভিযোগ রয়েছে, গুলিবর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আব্দুল্লাহিল কাফি সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদের পুত্রের বন্ধু।
যে কারণে আগে থেকেই ছিলো তার বিশেষ ক্ষমতা। এছাড়া পুলিশের এ কর্মকর্তার বাবা নিজ গ্রামের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা। তার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ডও আওয়ামীলীগের। এএসপি শাহিদুর রহমান ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা।
আশুলিয়া থানা পুলিশের মধ্যে সব থেকে ভয়ঙ্কর ছিলেন এএসআই বিশ্বজিত। লাশ পোড়ানোর ঘটনার ভিডিও ফুটেজে তাকে সনাক্ত করা গেছে। এসআই শিব শঙ্কর রিজার্ভ পুলিশের সদস্য হলেও আন্দোলন চলাকালে তার অবস্থান থানায় ছিলো বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এসআই রাকিবুল দ্বিতীয় দফায় পোস্টিং পান আশুলিয়া থানায়। এলাকা পরিচিত বলে আন্দোলন দমানোর চেষ্টায় তার ছিলো গুরু দায়িত্ব। ছিলেন কঠোর অবস্থানে।
এসআই অমিতাফ চৌধুরী ছিলেন আবদুল্লাহিল কাফির আস্থাভাজন ও বিশ্বাসী পুলিশ। আশুলিয়া থানার মিডিয়া সেলের এডমিনের দায়িত্ব পালন করতেন।
ঢাকা জেলা উত্তর ডিবির আরাফাতকে সনাক্ত করা গেছে ১৪ সেকেন্ডের ভিডিওতে। বর্তমানে তিনি পলাতক।
আশুলিয়া থানার ওসির অবর্তমানে দায়িত্ব পালন করা ওসি (তদন্ত) মাসুদুর রহমানের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ থাকলেও তিনি রয়ে গেছেন একই থানায়। বরং এখন ওসির দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং লাশ পোড়ানো প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গতকাল সন্ধ্যায় তিনি টেলিফোনে ইনকিলাবকে বলেন, ৫ আগস্ট বিকেল গড়াতেই তিনি সাভার ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নেন। মামলাসহ থানার অনুপস্থিত সদস্যসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান।
আশুলিয়া থানা পুলিশের এমন নৃশংসতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম না প্রকাশ করার শর্তে সেখানের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, ঘটনার সূত্রপাত ৪ আগস্ট সকাল থেকে। সেদিন বেলা ১১টার দিকে সাভার-আশুলিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য মো. সাইফুল ইসলাম তার দলীয় ক্যাডারদের নিয়ে বাইপাল মোড়ে ফুট ওভারব্রীজের দক্ষিণ পাশে অবস্থান করেন। এ সময় ব্রীজের উত্তর পাশে ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। এমপিসহ তার লোকজন এলোপাতাড়ি গুলি করে। এতে ওই দিন দুপুর পর্যন্ত তিনজন আন্দোলনকারী নিহত হন। বিকেলে ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেন আপামর জনতা। চলে দু’পক্ষের সংঘর্ষ। এমপির লোকজন গুলি করতে করতে থানা রোডের গলিতে চলে আসে। আর তখনই আওয়ামীলীগের লোকজনের সাথে যোগ দেয় পুলিশ সদস্যরা। অনেক আওয়ামীলীগ ক্যাডার তখন থানার ভেতরেও অবস্থান নেন।
বিজয়ের দিন ৫ আগস্ট সকাল ৯ টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত নিপীড়ক পুলিশ, স্থানীয় এমপি সাইফুল ইসলাম ও তার ক্যাডার বাহিনী ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুলিতে আশুলিয়ায় নিহত হন অন্তত ৩১ জন। গুলিবিদ্ধ হন আরো কয়েকশ’। পরে আরো কয়েকজন মারা যান।
সেদিন আশুলিয়া থানার পার্শ্ববর্তী অলিগলি কিংবা রাস্তা ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। নিজেদের বাসায়ও নিরাপত্তার অভাব ছিল স্থানীয়দের। পুলিশের ছোড়া গুলির গর্জনে চারদিক ছেয়ে গেছে, গুলি কখন কার জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে সে আতঙ্কে ছিলেন এলাকাবাসী।
বিকেল তিন টার দিকেই ছড়িয়ে পড়ে শেখ হাসিনার পালানোর খবর। ঠিক সে মুহূর্তেও পুলিশ থানার গেট বন্ধ করে ভেতর থেকেও গুলি করে। আন্দোলনকারীরা পুলিশকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন।
পুলিশ আন্দোলনকারীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে আত্মসমর্পণের কথা মাইকে ঘোষণা করেন। কিন্তু এরই মধ্যে তারা গুলিবিদ্ধ নিহত অনেকের লাশ চ্যাংদোলা করে পুলিশের ভ্যানে তোলে। পরে লাশগুলোতে আগুন দিয়ে আলামত ধ্বংস করে।
এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি করতে করতে থানা থেকে বের হয়। এভাবেই থানার দেড় শতাধিক পুলিশ একযোগে গুলি করতে করতে ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সেনাবাহিনীর কাছে সারেন্ডার করে অস্ত্র জমা দেন।
এদিকে লাশ পোড়ানো প্রসঙ্গে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আহাম্মদ মুঈদ থানা পরিদর্শন শেষে বলেন, আমরা ইতোমধ্যে চার জনকে আইডেন্টিফাই করেছি। তারা ওই থানার এলাকায় দায়িত্বে ছিলেন। পুলিশের এসব সদস্য পলাতক। তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য খোঁজা হচ্ছে।
এছাড়া অলরেডি একটা ইনকোয়ারি কমিটি করেছি। একটা কমপ্লিট রিপোর্ট আসবে। এ ঘটনাকে ‘ক্রিমিনাল অফেন্স’ হিসেবে অভিহিত করে তিনি জানান, এ ঘটনায় ফৌজদারি মামলার পাশাপাশি সরকারি চাকরিজীবীদের যে রুলস রয়েছে, সেটার আওতায়ও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।