ভাটি বাংলা ডেস্ক: ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ১:২৯:৫৭ অনলাইন সংস্করণ
আওয়ামী সরকারের পতন হলে দেশে লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে এমন আশঙ্কা ছিল দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থানে স্বৈরাচার হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে।
নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিন দিনেরও বেশি সময় দেশ ছিল সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীবিহীন।
এই সুযোগে কিছু কিছু জায়গায় বিশৃঙ্খলা হলেও, ওবায়দুল কাদের যে আশঙ্কা করেছিলেন তার কিছুই হয়নি। বরং এই সময়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে দলটির নেতাকর্মীরা দেশজুড়ে ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে, পাড়া-মহল্লায় শৃঙ্খলা ফেরাতে সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়ে দিয়েছেন পাহাড়া। কোন ধরণের বিশৃঙ্খলায় না জড়াতে কঠোর নির্দেশ ছিল বিএনপির শীর্ষ নেতার।
দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে স্বৈরাচারবিরোধী ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলন করতে গিয়ে ইতিহাসের বর্বরোচিত নির্যাতনের শিকার, একের পর এক হামলা-মামলা, গ্রেফতারে জর্জরিত, গুম-খুনে নিঃশ্ব নেতাকর্মীরা এমন অবস্থায়ও তারেক রহমানের প্রতি অবিচল বিশ্বাস ও আস্থা রেখে সুশৃঙ্খল থেকেছেন বিএনপির পতাকাতলে।
তবে এরপরও কিছু কিছু জায়গায় দলটির কোন কোন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। অনেকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজী, দখল, আওয়ামী সুবিধাভোগীদের আশ্রয় দেয়ার অভিযোগ উঠে। এর কোনটিকেই প্রশ্রয় দেয়নি বিএনপি।
যাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে তাদেরকেই দল থেকে শোকজ, ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। সন্তোষজনক না হলে করা হয়েছে বহিষ্কার। আবার কারো কারো বিরুদ্ধে বিএনপির পক্ষ থেকেই করা হয়েছে মামলা।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, দল কিংবা দলের নাম ব্যবহার করে অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এরই মধ্যে সারা দেশে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার কিংবা পদ স্থগিত করা হয়েছে।
এছাড়া অনেককে শোকজ করা হয়েছে। এ তালিকায় স্থায়ী কমিটির সদস্য, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতারাও রয়েছেন।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সুস্পষ্ট বার্তা ‘কোন ধরণের বিশৃঙ্খলা, অনৈতিক, অপকর্ম, উচ্ছৃঙ্খল কর্মকাণ্ড বরদাস্ত করা হবে না।
সে দলের যে কোন পর্যায়ের নেতাই হোক না কেন। যারাই অপকর্মে জড়িত হবে তাদের বিরুদ্ধে দলের জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা, অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতাদের।
শুধু শোকজ আর বহিষ্কারই নয়, সাংগঠনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি নেয়া হচ্ছে আইনি পদক্ষেপও। ইতোমধ্যে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল তাদের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে বহিষ্কারের পাশাপাশি মামলাও দিয়েছে। বিএনপির দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় অন্তত দশটি এজাহারও দায়ের করা হয়েছে।
বিএনপি নেতাকর্মীরা বলেন, ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর পরই দলের পক্ষ থেকে সকলকে শান্ত থাকা, কোন ধরণের বিশৃঙ্খলায় সম্পৃক্ত না হওয়া, যেকোন ধরণের নৈরাজ্য প্রতিরোধ করা এবং দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও স্বস্তি ফেরাতে কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া হাসপাতাল থেকেই নেতাকর্মীদের শান্ত থাকার বার্তা দিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দিয়েছেন একই বার্তা। এছাড়া তিনি ধারাবাহিকভাবে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে করেছেন বৈঠক।
প্রতিটি বৈঠকেই দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক করে দিচ্ছেন কোন ধরণের শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনায় জড়িত হলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। অনেক ক্ষেত্রে সেটি নিশ্চিতও করা হয়েছে।
জানা গেছে, দল কিংবা দলের নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি-দখলদারিসহ নানা অপকর্মে জড়িতদের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে বিশেষ সেলও গঠন করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তদন্ত সাপেক্ষে সেলের সদস্যদের রিপোর্টের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন তিনি। সম্প্রতি ময়মনসিংহে বিএনপির এক নেতার বিরুদ্ধে দলের পক্ষ থেকে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
বিএনপির নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনৈতিক সুবিধা আদায়ের অভিযোগে ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক ও ভালুকা উপজেলা শাখার আহ্বায়ক ফখরুদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে প্রথমে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর সোমবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে দলের পক্ষে যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ভালুকা থানায় বাচ্চুসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১৫ থেকে ২০ জনের বিরুদ্ধে লিখিত এজাহার দায়ের করেন। এছাড়া একই কারণে জয়পুরহাটে ও রাজধানীর পল্টন, রমনা ও কলাবাগান থানায়ও দল ও সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে এজাহার দায়ের করা হয়েছে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের পক্ষ থেকে।
৪ নভেম্বর পটিয়া পৌরসভা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. মামুনসহ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিএনপির নাম ব্যবহার করে অপরাধে জড়িত হওয়ার অপরাধে পটিয়া থানায় মামলা করেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবদলের সভাপতি মো. শাহজাহান।
মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি গাড়ি থামিয়ে ৬৫ ভরি স্বর্ণসহ অর্থ জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়। এই ঘটনার পর মামুনকে বহিষ্কারের পর মামলা দেয়া হয় দলের পক্ষ থেকে।
কোনো অপকর্ম করলে বরদাস্ত করা হবে না বলে নেতাকর্মীদের কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি আব্দুল মোনায়েম মুন্না।
তিনি বলেন, যুবদলের কেউ কোনো অনৈতিক কাজ কিংবা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকলে তা বরদাস্ত করা হবে না।
তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সোপর্দ করা হবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির মতো যুবদলেরও ‘জিরো টলারেন্স নীতি’। যেকোনো মূল্যে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে যুবদল বদ্ধপরিকর।
তবে শুধু যে দলীয় নেতাকর্মীরাই অপকর্মে জড়াচ্ছে তা নয়, বরং বিএনপির নাম নিয়ে অনেকেই দেশজুড়ে অপকর্মে জড়িত হচ্ছে।
গত ২ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলায় কাওসার শিকদার মনির নামে এক ব্যক্তি যুবদলের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজী করে। পরে যুবদলের নেতাকর্মীরা তাকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে এবং তার বিরুদ্ধে মামলা করে।
যুবদলের পক্ষ থেকে বলা হয়, কাওসার শিকদার মনির নামীয় দুষ্কৃতীকারী উদ্দেশ্যমূলকভাবে জাতীয়তাবাদী যুবদলের পরিচয় প্রদান করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজীসহ বিভিন্ন অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে বলে আমাদের কাছে তথ্য এসেছে। প্রকৃতপক্ষে এই প্রতারকের সাথে জাতীয়তাবাদী যুবদলের কোনরূপ সংশ্লিষ্টতা কখনোই ছিল না। এর দায়ভার যুবদল বহন করবে না। যুবদলের সভাপতি মোনায়েম মুন্না ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন তাকে পাওয়া মাত্রই পুলিশের হাতে সোপর্দ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।
এছাড়া দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দীন আহমেদ এস আলম গ্রুপের গাড়ীতে চড়ার কারণে ব্যাখ্যা চাওয়া, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের মালিক দিলীপ আগারওয়ালের সঙ্গে ছবি প্রকাশ হওয়ায় যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনকে শোকজ, এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের পরিবারের ব্যবহৃত ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি সরিয়ে নিতে সহায়তার অভিযোগ উঠে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় গতকালই চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম এবং কর্ণফুলী থানা বিএনপির আহ্বায়ক এসএম মামুন মিয়াকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে দক্ষিণ জেলা কমিটি স্থগিতও করা হয়।
এর আগে শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজের কারণে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর পদাবনতী, সাংগঠনিক সম্পাদক শ্যামা ওবায়েদ, বিলকিস জাহান শিরিন, কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুলের পদ স্থগিত করা হয়েছে। বিএনপি দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ৫ আগস্টের পর থেকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করায় বিএনপির দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে অর্ধশতাধিক জনকে এবং পদ স্থগিত করা হয়েছে আরো বেশকিছু নেতাকর্মীর।
স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের দোসররা এখনও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে উল্লেখ করে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক বলেন, আমরা আর কোন দুর্নীতিবাজ, লুটতরাজ, দখলদার, স্বৈরাচারী সরকার বাংলাদেশে হউক তা দেখতে চাই না, বাংলাদেশে কোন স্বৈরাচারের স্থান নেই। স্বৈরাচার মুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়তে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, বড় কিছু অর্জন করতে হলে ছোট কিছু হারাতে হয় এবং হারানোর সেই উদাহরণ আমরা ইতোমধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে সৃষ্টি করেছি। আমরা আমাদের দলের একজন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ স্থগিত করেছি। দলের চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া হাসপাতাল থেকে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও একই ধরনের বার্তা দিয়েছেন।
এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়েছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তৃণমূলের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে নেতাকর্মীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দেশপ্রেম, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ত্যাগ আর শত সহস্র নেতাকর্মীর আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিএনপি জনগণের আস্থা আর বিশ্বাসের যে জায়গায় পৌছেছে, কতিপয় বিপথগামীর হঠকারিতায় সেটা বিনষ্ট হতে দেয়া হবে না। এ বিষয়ে দল আপোষহীন, তিনি দলের কত শীর্ষে অবস্থান করেন সেটা বিবেচ্য নয়। সম্প্রতি চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে দল সেটার প্রমাণ রেখেছে বলেও তিনি জানান।