ভাটি বাংলা ডেস্কঃ ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ২:২১:৫২ অনলাইন সংস্করণ
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সাঁড়াশি অভিযানে নেমেছে যৌথ বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সদ্য গঠিত অন্তর্বতীকালীন সরকার নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে।
তবে আন্দোলনের সময় থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র-গুলির একটি বড় অংশ এখনো দুর্বৃত্তদের হাতে রয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া আ’লীগ সরকারের আমলে গণহারে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেয়ায় পলিটিক্যাল ক্যাডার ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা এ সুযোগ নিয়ে বৈধ অস্ত্র কিনেছে। যা পরবর্তীতে তারা খুন, চাঁদাবাজি, ভূমি দখলসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে এসব বৈধ অস্ত্র দিয়ে অবৈধভাবে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। এতে বিপুল সংখ্যক আন্দোলনকারী আহত ও নিহত হলেও ওইসব পলিটিক্যাল আর্মস ক্যাডাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে সন্দেহভাজন অস্ত্রধারীদের একটি তালিকাও তৈরি করেছে সরকারের একটি সংস্থা। ওই তালিকায় রয়েছে ১৫ হাজার অবৈধ অস্ত্রধারীর নাম। তালিকা তৈরিতে কোনো দলীয় বিবেচনা কাজ করেনি। অপরাধীদের পরিচয় যাই হোক আইনের আওতায় আনার উদ্দেশ্যেই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। গত ১৫ বছরে সাধারণ মানুষকে নির্যাতন, হয়রানি, দখল বাণিজ্য, অনিয়ম এবং সিন্ডিকেট করে রাষ্ট্রীয় অর্থ তছরুপ যারা করেছেন তালিকায় তারাও রয়েছেন। সমাজকে অস্থিতিশীল করার সঙ্গে জড়িত কিশোর গ্যাং এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদেরও আইনের আওতায় আনতে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
অন্তর্বতী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব:) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহের জন্য আজ বুধবার রাত ১২টা থেকে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার ছিল সব বৈধ এবং অবৈধ অস্ত্র জমাদানের শেষ দিন। যৌথ বাহিনীর অপারেশন শুরু হাতিয়ার কালেকশনের জন্য, আমরা যেন অবৈধ অস্ত্রগুলো সংগ্রহ করতে পারি।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, গত ৫ আগস্ট আ’লীগ সরকারের পতনের পর লুটপাট, চাঁদাবাজি এবং দখল বাণিজ্যে সক্রিয় হওয়া ব্যক্তিদেরও এ তালিকায় রাখা হয়েছে। এজন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় কারাগারসহ ৬৭টি কারাগার। শেখ হাসিনা সরকার পতনের আগে নরসিংদী এবং শেরপুর কারাগারে হামলার ঘটনায় বেশ কিছুদিন ওই দুটি কারাগারের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তবে ইতোমধ্যে নরসিংদী কারাগার চালু হয়েছে। তবে শেরপুর কারাগারের বন্দিদের ক্যাটাগরি অনুসারে ময়মনসিংহ এবং জামালপুরে রাখছে কারা কর্তৃপক্ষ। বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার বন্দিদের ক্ষেত্রেও এ নিয়ম অনুসরণ করবে কারা কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে দুর্ধষ এবং ভয়ংকর বন্দিদের ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। অবৈধ অস্ত্র অভিযান সফল হলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ইতিবাচক উন্নতি হবে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর দুর্বৃত্তদের একটি অংশ সারা দেশে যে দখল বাণিজ্য শুরু করেছে তার লাগাম টানা সম্ভব হবে। যেসব দুর্বৃৃত্ত ১৫ বছর ধরে সাধারণ মানুষের ওপর যথেচ্ছতা চালিয়েছে তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুযোগ মিলবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি গোয়েন্দা সংস্থা একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, অবৈধ অস্ত্র অভিযান সফল করতে হলে দুর্বৃত্তরা যাতে পালাতে না পারে তা নিশ্চিত করাও জরুরি। সীমান্তে প্রহরা বসানোর পাশাপাশি ছাত্রসহ সৎ নাগরিকদের নিয়ে সীমান্ত এলাকায় বিশেষ কমিটি গঠনের সম্ভাব্যতা ভাবা যেতে পারে। যারা সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথে ভারত বা মিয়ানমারে অপরাধীদের পলায়ন রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতা করতে ভূমিকা রাখবে।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেয়া অস্ত্রের লাইসেন্সও স্থগিত করে সেগুলো থানায় জমা দেয়ার জন্য ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয় সরকার। তবে এরপরও এসব অস্ত্র খুব বেশি জমা পড়েনি। রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া এক বার্তায় বলা হয়, ৪ সেপ্টেম্বর থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে। এর আগে গত ২৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিক জনগণকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে।
ওই সময়ে পর্যন্ত যাদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, তাদের আগামী ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গোলাবারুদসহ আগ্নেয়াস্ত্র-সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, দেশে এখন বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা কমবেশি ৫০ হাজার। এর মধ্যে ১০ হাজারের বেশি অস্ত্র রয়েছে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের হাতে। তাদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। যাদের অনেকেই ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের সময়ে অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন।
আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম বলেন, নির্দেশনা অনুযায়ী ৩ সেপ্টেম্বরের পর কারও কাছে কোনো অস্ত্র থাকলে সেটা অবৈধ বলে গণ্য হবে। অভিযানে সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগিতা নেওয়া হবে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা যেহেতু বেসামরিক প্রশাসনকে সহযোগিতা করার জন্য মাঠে আছে, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিযানে তাদেরও সহযোগিতা নেওয়া হবে। থানা-ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করা হবে।
তাছাড়া দাগি অপরাধী ও ছাত্র-জনতার হত্যাকারীদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, আন্দোলনের সময় দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের লোকজনও বৈধ ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করেছে। তারাও ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়েছে। গত ১৫ বছরে এক লাখের বেশি অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, যা আইনশৃঙ্খলার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈধ অস্ত্র জমা দেওয়ার ঘোষণায় শিল্পপতি, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে অস্বস্তি। অনেকে নিজেদের নিরাপত্তাহীনতায় শঙ্কা দেখছেন।
পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সারাদেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩১০। এর মধ্যে ব্যক্তিগত অস্ত্র ৪৫ হাজার ২২৬টি। এগুলোর মধ্যে পিস্তল ৪ হাজার ৬৮৩টি, রিভলবার ২ হাজার ৪৩টি, একনলা বন্দুক ২০ হাজার ৮০৯টি, দোনলা বন্দুক ১০ হাজার ৭১৯টি, শটগান ৫ হাজার ৪৪৪টি, রাইফেল ১ হাজার ৭০৬টি এবং অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে ৪ হাজার ৬টি। বাকি অস্ত্রগুলো বিভিন্ন আর্থিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স করা। প্রাপ্ত হিসাব বলছে, এসব অস্ত্রের মধ্যে ১০ হাজার ২১৫টি রয়েছে রাজনীতিবিদদের কাছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে রয়েছে ৭ হাজার ২১৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। বিএনপির নেতাকর্মীর কাছে ২ হাজার ৫৮৭টি এবং অন্যান্য দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নামে ৭৯টি বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে।
ডিএমপি সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সবচেয়ে বেশি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের। ওই সময়ে রাজধানীর বিভিন্ন থানা থেকে ১ হাজার ৮৯৮টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছে। খোয়া যাওয়া বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের মধ্যে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত ৪৫৩টি উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ১ হাজার ৪৪৫ অস্ত্র এখনো উদ্ধার করা যায়নি। পুলিশের খোয়া যাওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ৩৪৮টি চায়না রাইফেল, শটগান ৭০৩টি, ৩০টি এসএমজি (টি ৫৬ চায়না মডেল), ১৩টি এলএমজি, ৮৯টি পিস্তল (টি-৫৪ চায়না), ৫৬০টি পিস্তল, ১৫২টি গ্যাসগান ও ৩টি টিয়ার গ্যাস লাঞ্চার।