নিজস্ব প্রতিবেদক: ১১ মার্চ ২০২৪ , ২:৩০:১৫ অনলাইন সংস্করণ
‘প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আজিজ আমাকে একবার বলেছিলেন যে, তিনি (তারিক আজিজ) গত চার দিনে দুবার আসিফ আলি জারদারির সাথে দেখা করেছেন।’
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত অ্যান প্যাটারসন ২০০৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এক চিঠিতে এটি জানান তার দেশের সরকারকে। উইকিলিকস যুক্তরাষ্ট্রের যেসব গোপন কূটনৈতিক নথি প্রকাশ করেছে সেখানে এটি পাওয়া যায়।
এখানে মনে রাখা দরকার যে ২০০৮ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৮ ফেব্রুয়ারি, আর উইকিলিকস প্রকাশিত এই নথিতে দেখা যাচ্ছে নির্বাচনের আগ দিয়ে আসিফ জারদারি সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের উপদেষ্টা তারিক আজিজের সাথে আলোচনা করেন যে, যদি পিপলস পার্টি নির্বাচনে অংশ নিয়ে জেতে, তাহলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন?
প্রকাশিত এই নথি অনুযায়ী, তারিক আজিজ এবং সে সময়ের আইএসআই প্রধান জেনারেল নাদিম তাজ আসিফ জারদারিকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, যাতে তিনি প্রধানমন্ত্রী না হন এবং সে জায়গায় তার দলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মখদুম আমিন ফাহিমকে সমর্থন দেন।
২০০৮ সালে ৭ ফেব্রুয়ারির আরেকটা নথিতে দেখা যায় অ্যান প্যাটারসন লিখেছেন, তাকে তারিক আজিজ বলছেন যে আসিফ জারদারিকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব পুরোপুরি নাকচ করে দেন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ।
ওই নথি অনুযায়ী তারিক আজিজ বলেছেন, জারদারিকে তখনই সমর্থন করা হবে যখন তিনি পর্দার পেছনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দেবেন।
আজিজ বলেন, সেটা তাহলে বতর্মান (সেনাবাহিনী) নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের জন্য সুবিধা হয়, কারণ বেনজির ভুট্টোর তুলনায় তার স্বামী জারদারির সাথে বোঝাপড়া সহজ।
প্রায় ১৫ বছর আগে উইকিলিকসে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের এসব নথির ব্যাপারে সাবেক প্রেসিডেন্ট জারদারি বা পাকিস্তান পিপলস পার্টি কারো কাছ থেকেই কখনো কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে এটা ঠিক যে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরে আসিফ জারদারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হননি, কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন।
আর এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলস্বরূপ তিনি পাকিস্তানের ১৪তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিচ্ছেন, যা পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম রাজনীতিবিদ হিসেবে দ্বিতীয় দফা প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসার বিরল এক রেকর্ড।
এই প্রতিবেদনে আসিফ আলি জারদারির রাজনৈতিক জীবন তুলে আনা হয়েছে, যেখানে শুরুতেই উঠে আসে এক ‘কাউন্সিলর’ নির্বাচনের কথা যেখানে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন।
যখন কাউন্সিল নির্বাচনে হেরেছিলেন
১৯৫৫ সালে জন্ম নেয়া আসিফ আলি জারদারি তিন কন্যার সাথে তার বাবা-মায়ের একমাত্র পুত্র। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন সেন্ট প্যাট্রিক স্কুল থেকে, তারপর তিনি পাতারো ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন, আর তার যে আত্মজীবনী লেখা সেখানে বলা আছে এরপর তিনি লন্ডন থেকে বিজনেসের উপর স্নাতক সম্পূর্ণ করেন।
আসিফ আলি জারদারির বাবা হাকিম আলি জারদারি চলচ্চিত্র ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। জমিদারি ছাড়াও তিনি করাচিতে নির্মাণ ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন এবং তিনি একসময় শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের সাথে রাজনীতি করতেন।
পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের রেকর্ড ঘেঁটে জানা যায়, হাকিম জারদারি ১৯৮৫ সালে জেনারেল জিয়াউল হকের সময় নওয়াবশাহ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন।
তবে তার বাবার নির্বাচনের আগেই আসিফ আলী জারদারি নওয়াবশাহ জেলা কাউন্সিল নির্বাচনে প্রার্থী হন এবং হেরে যান।
১৯৮৩ সালের সেই সময়টায় সিন্ধু প্রদেশে গণতন্ত্র পুর্নবহালের দাবিতে জোরদার আন্দোলন চলছিল এবং ওই একই বছর নওয়াবশাহর সাকরান্দ শহরের ‘পানহাল চান্দিও’ গ্রামে সেনাবাহিনীর দেয়া আগুনে ১৬ জন পিপিপি কর্মী মারা যায় এবং ৫০ জন আহত হয়।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসিফ আলি জারদারিকে বর্ণনা করা হয় একজন ‘চতুর’ রাজনীতিবিদ হিসেবে।
তবে পাকিস্তানের মানুষ ১৯৮৭ সালের আগে আসিফ আলি জারদারির নামের সাথে পরিচিত ছিল না। সে বছরের ডিসেম্বরে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভু্ট্টোর মেয়ে, আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকে বিয়ে করেন এবং তারপরই তার নাম সারা দেশে পরিচিত হয়ে পড়ে।
তাদের বিয়ের পরের বছর ১৯৮৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি জয়লাভ করে এবং দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন বেনজির ভুট্টো।
বেনজির তার স্বামীকে প্রধানমন্ত্রী ভবনে নিয়ে আসেন, আর তারপরই আসিফ জারদারির রাজনীতি, বিতর্ক এবং দুর্নীতির যে অভিযোগ, সেটার অধ্যায় শুরু হয়।
‘মি. টেন পার্সেন্ট’ ও অন্যান্য অভিযোগ
প্রেসিডেন্ট গোলাম ইশাক খান বেনজির ভুট্টোর নির্বাচিত সরকারকে দুই বছরের মাথায় বাতিল করেন এবং সংসদ ভেঙে দেন।
আর সংসদ ভেঙে দেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর আসিফ আলি জারদারি প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হন, এরপর নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ সরকার গঠন করে।
তিনি ছাড়া পান ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যখন নওয়াজ শরিফের সরকারও ভেঙে যায়।
আসিফ জারদারি আর্থিক দুর্নীতি, অপহরণ, ক্ষমতার অপব্যবহারের নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হন, কিন্তু সেসব কোনোটাই কখনো আদালতে প্রমাণিত হয়নি।
নব্বইয়ের দশকেই সরকারি বিভিন্ন চুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগে তার নামের সাথে ‘মি. টেন পার্সেন্ট’ ট্যাগ যুক্ত হয়, যা তাকে বছরের পর বছর তাড়া করেছে, এবং এই অভিযোগও কখনো আদালতে প্রমাণিত হয়নি।
১৯৯৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে আবারো পিপলস পার্টি জয়লাভ করে এবং দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন বেনজির ভুট্টো। কিন্তু এবারো তার সরকার পুরো মেয়াদ শেষ করার আগেই ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে ক্ষমতাচ্যুত হয়।
বেনজির সরকারের এই দ্বিতীয় মেয়াদে আসিফ জারদারির বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
বেনজির সরকারের যখন পতন ঘটে সেসময় আসিফ জারদারি দুবাইয়ে ছিলেন এবং দুবাই থেকে পাকিস্তানে ফেরার পর দিনই গ্রেফতার হন তিনি।
দীর্ঘ কারাবাস
আসিফ জারদারি দ্বিতীয় দফা আটক থাকাকালে পাকিস্তানে দুইটি সরকারের পরিবর্তন ঘটে, যেখানে প্রথমে নওয়াজ শরিফ আসেন এবং পরে মার্শাল ল জারি করে ক্ষমতা নেন জেনারেল মোশাররফ।
যদিও সে সময় পিপলস পার্টির নেতাদের ধারণা ছিল সরকারে পরিবর্তন এলে জারদারি মুক্তি পাবেন। কিন্তু সেরকমটা ঘটেনি।
আসিফ জারদারির বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও হত্যার অভিযোগ ওঠে। বেনজির ভুট্টোর ভাই মুর্তুজা ভুট্টোকে হত্যার অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে, যেই অভিযোগ থেকে পরে মুক্তি পান তিনি।
জারদারির মুক্তি তখনই সম্ভব হয় যখন তার দল পিপলস পার্টি পারভেজ মোশাররফের সাথে একটা বোঝাপড়ায় আসে, যাতে জেনারেল মোশাররফ ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন অর্ডিন্যান্স (এনআরও) জারি করেন, ফলে জারদারির বিরুদ্ধে মামলাগুলো বাতিল হয়ে যায়, পরে আদালত থেকেও এসব মামলায় ছাড়া পান তিনি।
তার এই দীর্ঘ কারাবাস তাকে পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে কারাগারে থাকা রাজনীতিবিদে পরিণত করে। পরে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কারাগারের সময়টা তাকে জীবন সম্পর্কে অনেক শিক্ষা দিয়েছে।
তার অনুপস্থিতিতে ছেলেমেয়েদের পুরো ভার পড়ে বেনজির ভুট্টোর উপর।
গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আসিফ জারদারি বলেন, কারাগারে থাকার সময় তিনি তার সন্তানদের বড় হওয়া দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মুক্তির পরপরই তিনি প্রথমে দুবাই চলে যান ও সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন।
পাকিস্তান খাপ্পে ও মূল ধারার রাজনীতি
যখন বেনজির ভুট্টো স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে ২০০৭ সালে ১৮ অক্টোবর পাকিস্তানে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন, সে সময় ছেলেমেয়েদের নিয়ে দুবাইতে থেকে যান আসিফ জারদারি।
এরপর ২০০৭ সালে ২৭ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডির লিয়াকত বাগ এক আত্মঘাতী হামলায় বেনজির ভুট্টো মারা যাওয়ার পর দেশে ফেরেন জারদারি।
তার স্ত্রীর দাফনের পর সেখানে কর্মী-সমর্থকরা চিৎকার করতে থাকেন ‘পাকিস্তান খাপ্পে’ বা ‘আমরা পাকিস্তান চাই’ এমন স্লোগানে।
এরপর নিজের প্রথম বক্তৃতায় এই স্লোগান দেন জারদারি যা পরে তার নিজের ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির স্লোগানে পরিণত হয়।
এরপর তিনি নিজে দলের নেতৃত্ব নেয়ার বদলে সেই দায়িত্ব দেন তার যুবক ছেলে শিক্ষার্থী বিলাওয়াল ভুট্টোর ওপর, এবং সেসময় তার নাম বদলে রাখেন ‘বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি’।
তার এই কৌশলটা বেশ কাজে দেয়, কারণ এতে করে তাকে দলের ভেতর আর কোনো বিরোধিতায় পড়তে হয় না, আবার একই সাথে মূল নিয়ন্ত্রণও থাকে তার কাছেই।
২০০৮ সালের নির্বাচনে পিপলস পার্টি জয়লাভ করে এবং ইউসুফ রেজা গিলানিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেয়, যদিও সাধারণে একটা ধারণা ছিল যে এই পদে আসবেন সিন্ধ প্রদেশের সিনিয়র নেতা মাখদুম আমিন ফাহিম। কিন্তু সেটাই ছিল প্রথম যে পিপলস পার্টির কোন প্রধানমন্ত্রী সিন্ধ থেকে নয়, বরং পাঞ্জাব থেকে আসেন।
শুরুতে পিপিপি সরকারকে সমর্থন দেয় মুসলিম লীগ (এন), তবে এই মৈত্রী বেশিদিন থাকেনি। বিরোধিতা দেখা দেয় জেনারেল মোশাররফের অপসারণ করা প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরি ও অন্যান্য বিচারকের আবারো পুর্নবহাল নিয়ে।
দুই পক্ষই প্রেসিডেন্ট মোশাররফের অভিশংসন চায়, কিন্তু একই সময় জারদারির এই বক্তব্য সামনে চলে আসে যে ‘যদি মোশাররফ সরে দাঁড়ান তাহলে তাকে নিরাপদে দেশের বাইরে পাঠানো হবে।’
এক সময় মোশাররফ সরে দাঁড়ান এবং জারদারি নিজে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন।
এমকিউএম, জামিয়াত উলামা-এ-ইসলাম, আফতাব শেরপাউ এবং পিএমএল(কিউ)-এর ফরোয়ার্ড ব্লক তাকে এই পদের জন্য সমর্থন করে, অন্যদিকে পিএমএল-এন এবং পিএমএল-কিউ তার বিরুদ্ধে তাদের প্রার্থী দাঁড় করায়, যারা হেরে যায়।
মেয়াদ পূর্ণ করা দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি
আসিফ জারদারি ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
চৌধুরী ফজল এলাহীর পর তিনি হলেন দ্বিতীয় বেসামরিক প্রেসিডেন্ট যিনি নিজের মেয়াদ পুরো করতে পেরেছেন।
প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তার উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে ছিল সংসদে বিধানসভা স্থগিত করার ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া, সংবিধানের ১৮তম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন পুনরুদ্ধার, আদিবাসীদের প্রশাসনে এফএটিএ সংস্কার এবং বাল্টিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশের নাম পরিবর্তন করে খাইবার পাখতুনখোয়া করা।
সামরিক শক্তির সাথে সমঝোতা করে চলা
আসিফ জারদারি যখন জেনারেল পারভেজ মোশাররফের আট বছর শাসনামলের পর বেসামরিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার মেয়াদ শুরু করেন, তখন তিনি সেনাবাহিনীর সাথে একটা ভারসাম্যের সম্পর্কে বজায় রেখে চলার চেষ্টা করেন।
উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক নথি অনুযায়ী, মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাটারসন তার সরকারকে এক চিঠিতে লেখেন, আশফাক কায়ানি (তৎকালীন সেনাপ্রধান) জারদারিকে সরানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন, কিন্তু জারদারিও বলেছেন যে তিনি এখান থেকে গেলে কেবল অ্যাম্বুলেন্সে করেই যাবেন।
পাকিস্তানি সামরিক শক্তির সাথে বিরোধিতা রেখে রাজনীতিবিদদের ক্ষমতায় যাওয়া সাধারণত বেশ কঠিন। কিন্তু আসিফ আলি জারদারি দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হলেন কীভাবে?
বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক সোহাইল ওয়াররাইছ বলেন, যখন থেকে জারদারির কাছে পিপিপির নেতৃত্ব এসেছে তখন থেকে তিনি তাদের যে সামরিক বিরোধী ভাবমূর্তি সেটা বদলাতে চেষ্টা করছেন। সে কারণে তিনি আজ পর্যন্ত কোনো প্রতিবাদ কর্মসূচি দেননি এবং যদি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তার কোনো ক্ষোভ থেকেও থাকে সেটাকে তিনি সরিয়ে রেখেছেন।
‘তিনি প্রেসিডেন্ট ভবনে থাকাকালীন মেমোগেট স্ক্যান্ডাল ঘটে, আবার একবার জেনারেল রাহিল শরিফের সাথেও তার দ্বন্দ্ব দেখা যায়, কিন্তু তিনি সেটার সমাধান করে তার নিজেকে ও দলকে বিপদমুক্ত রাখেন।’
‘সম্ভবত তার নেতৃত্বের কৌশল এটাই যে আমাদের আর যাতে জেলে যেতে না হয় ও চাবুকের বাড়ি খেতে না হয়,’ বলেন সোহাইল ওয়াররাইছ।
শহীদ জুলফিকার আলী ভুট্টো ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক ড. রিয়াজ শেখ মনে করেন, আসিফ জারদারি রাজনীতিবিদ হিসেবে বেশ সহনশীল, যা ইমরান খান ও নওয়াজ শরিফের মধ্যে দেখা যায় না।
ড. রিয়াজ জানান, আসিফ জারদারির প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মেয়াদে অন্তত চার থেকে পাঁচবার পিপিপির সাথে সেনাবাহিনীর একটা সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কিন্তু প্রতিবারই তিনি সেটা এড়িয়েছেন এবং সামরিক শক্তিকে তুষ্ট করেই সামনে চলেছেন।
আসিফ জারদারি প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন আরেকটা ঘটনার কথা বলেন ড. রিয়াজ শেখ। মন্ত্রিসভা থেকে সিদ্ধান্ত হয় গোয়েন্দা সংস্থা ও আইএসআই দুটোই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে, এ নিয়ে নির্দেশনাও জারি হয়, কিন্তু এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে সেনাবাহিনী এবং এক পর্যায়ে সরকার তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক রেমন্ড ডেভিসকে গ্রেফতার বা অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুসংবাদ – এ সকল ক্ষেত্রেই জারদারি সেনাবাহিনীর মতানুসারেই চলেছে। এটাই তাদের টিকে থাকতে সাহায্য করেছে বলে মনে করেন ড. রিয়াজ।
লিমজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ‘পলিটিক্যাল কনফ্লিক্ট অব পাকিস্তান’ বইয়ের লেখক মোহাম্মদ ওয়াসিম বলেন, জারদারি কখনওই সেনাবাহিনীর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াননি।
তিনি মনে করেন, জুলফিকার আলি ভুট্টো বা বেনজির ভুট্টোর মতো আসিফ আলি জারদারির মধ্যে খুব চমকপ্রদ কোনো ব্যাপার নেই, তিনি কখনো সরাসরি জনগণের কাছে যান না বা তাদেরকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলেন না।
যে কারণে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট
২০০৮ সালে আসিফ আলি জারদারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মুসলিম লীগ-এন-এর প্রার্থীর বিপক্ষে, আর এবার তিনি পিপলস পার্টি ও মুসলিম লীগ-এনের যৌথ প্রার্থী।
বিলাওয়াল ভু্ট্টো কিছুদিন আগে বলেন, পিপিপি সরকারের কোনও অংশ হবে না, তবে তিনি চান তার বাবা প্রেসিডেন্ট হোক।
আসিফ জারদারি কেন প্রেসিডেন্ট পদকে বেছে নিলেন?
এর উত্তরে ড. রিয়াজ শেখ বলেন, পাকিস্তানের আইন ও সংবিধান প্রেসিডেন্টকে চূড়ান্ত ক্ষমতা দেয়। তিনি যতদিন প্রেসিডেন্ট ভবনে আছেন, তার বিরুদ্ধে কোনও মামলা বা কোনও রকম আইনি পদক্ষেপ নেয়া যাবে না।
তবে পাকিস্তানের সংসদীয় পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রী। তাই আসিফ জারদারি বলতে পারবেন যা কিছু করা হচ্ছে সেটা মুসলিম লীগ সরকার ও তাদের প্রধানমন্ত্রী করছেন।
ড. রিয়াজ শেখের আরেকটা মতামত হল, পিএমএল-এন সরকার যখন বেসরকারিকরণ বা এরকম কোনও বড় সিদ্ধান্ত নেবে তখন সেসব আইন প্রেসিডেন্টের কাছেই যাবে, যিনি চাইলে এগুলোর বিরোধিতা করতে পারেন বা সংশোধনী দিতে পারেন।
যদিও কখনো কখনো সংসদে আইনপ্রণেতাদের দ্বারা কোনো কিছু পাস হলে সেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইন হয়ে যায়, তারপরও ‘জনবিরোধী’ কোনো বিলে স্বাক্ষর না করে প্রেসিডেন্ট জনপ্রিয়তা পেতে পারেন।
তবে অধ্যাপক ওয়াসিমের মতে, জারদারির আবারো প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়াটা একটা ‘দুর্বল সিদ্ধান্ত’।
তিনি বলেন, ‘পিপলস পার্টি ভেবেছে যে এই সরকার বেশিদিন টিকে থাকবে না কারণ সরকারকে অনেক গুরুতর অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে, তাই বড় কোনো দায়িত্ব নেয়া উচিত নয়।’
‘কারণ তারা যদি সরকারের অংশ হয় তবে তাদের দায়িত্ব নিতে হবে, তাই কেবল সাংবিধানিক পদ গ্রহণ করা উচিত। যার অর্থ গভর্নরশিপ এবং রাষ্ট্রপতি পদ ইত্যাদি, যা পাঁচ বছর স্থায়ী হতে পারে।’
আসিফ জারদারির সামনে চ্যালেঞ্জ কী?
ড. রিয়াজ শেখ বলেন আসিফ জারদারি যে রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ভবনে বসতে যাচ্ছেন তাতে তাকে প্রচুর ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হবে।
অন্যদিকে খাইবার পাখতুনখোয়ায় ইমরান খানের দলের সরকার, অনেক বিষয় নিয়েই তারা কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে যোগযোগ করবে আর সেখানে সাড়া না পেলে তারা প্রেসিডেন্টের সাথে যোগাযোগ করবে।
বিশ্লেষক সোহাইল ওয়াররাইছ বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট একটা সাংবিধানিক পদ, তাকে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে না। তিনি শাসক ও প্রশাসকের মধ্যে এবং প্রদেশগুলোর মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করবেন।’
যেহেতু তিনি সরকার ব্যবস্থার একটা প্রতীক, তাই সেই অর্থে তার সামনে তেমন বিশেষ কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। তিনি সরকারকে তার মতো চলতে দেবেন ও বিভিন্ন প্রদেশগুলোর মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখতে কাজ করবেন।
আর পিএমল-এনও তাকে কোনো বাধা হিসেবে দেখছে না বলে মনে করেন ওয়াররাইছ। আর সে কারণেই তারা নির্দ্বিধায় তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিয়েছে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ ওয়াসিম বলেন শাহবাজ শরিফের রাজনৈতিক ধরন, আসিফ আলি জারদারির রাজনৈতিক ধরনের সাথে মিলে যায়।
তারা দুজনই সেনাবাহিনীর সাথে মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত। সে কারণে এবার হয়তো আগের পুনরাবৃত্তি খুব দ্রুত নাও হতে পারে বলে তার অভিমত।
সূত্র : বিবিসি