মাওলানা মুহাম্মাদ এমদাদুল হকঃ ১৭ রমজান, ঐতিহাসিক বদর দিবস। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ, হিজরি দ্বিতীয় বর্ষের ১৭ রমজান ৩১৩ জন সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে মহানবী (সা.) মদিনা শরিফের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ৮০ মাইল দূরে বদর নামক স্থানে কাফেরদের সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ইতিহাসে এ যুদ্ধকে বদর যুদ্ধ বলে অবহিত করা হয়। ঐতিহাসিক এ যুদ্ধের সেনাপতি ছিলেন রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ই রমজান বদরের ঐ ঐতিহাসিক জিহাদ সংঘটিত হয়ে মুসলমানদের তথা ইসলামের বিজয় সূচীত হয়েছিল। বদর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পবিত্র মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে ইসলাম তথা মুসলমানদের বিজয়ের ধারা সূচীত হয়েছিল এবং পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে আবু জাহালের ১০০০ সুজজ্জিত বাহিনীর বিপরীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ৩১৩ জন নিরস্ত্র সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহ তা’আলার গায়বী সাহায্যে আবু জাহালের বিশাল বাহিনীকে পর্যদুস্ত করেছিলেন অত্যন্ত কঠিনভাবে। বদরের যুদ্ধে মুশরিক বাহিনীর ২৪ জন সরদারের লাশ একটি নোংরা কূপে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এই যুদ্ধে দু’জন আনসার কিশোরসহোদর হযরত মা’আজ (রা.) ও হযরত মু’আজ (রা.) আবু জাহালকে হত্যা করেছিলেন। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাস’উদ (রা.) আবু জাহালের মাথা কেটে বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর নিকট হাজির করেছিলেন। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর ১৪ জন শহীদ হয়েছিলেন। আর মুশরিক বাহিনীর ৭০ জন নিহীত ও ৭০ জন বন্দি হয়েছিল। এরা ছিল গোত্রসমূহের সদরদার ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। এ জিহাদে ইসলাম ও রাসূল (সা.) এর ১৪ জন শুত্রু মধ্যে আবু জাহাল, উৎবা ও শায়বাসহ এগার জন জাহান্নামে পৌঁছে যায়। জিহাদ শেষে বদর প্রান্তরে নিয়ম অনুযায়ী ৩ দিন অবস্থান শেষে চতুর্থ দিনে রাসূল (সা.) মদীনার পথে যাত্রা করেছিলেন। এ সময়ে তাঁর সাথে ছিলো বন্দিরা ও গণিমতের মালামাল। আর এসবের তত্ত¡াবধানে ছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে কা’ব (রা.)। রাসূল (সা.) ছাফরা প্রান্তরে কাফের বাহিনীর পতাকা বহনকারী নজর ইবনে হারেসকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যেসব পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কারণে বদর যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল তা হচ্ছে, মদীনা শরীফে সফলভাবে ইসলাম ও ইসলামী শাসন সু-প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কুরাইশদের হিংসা, আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও ইহুদীদের ষড়যন্ত্র, সন্ধির শর্তভঙ্গী, কুরাইশদের যুদ্ধের হুমকি, বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা, কাফেরদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা, ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তির ধবংস সাধনের অপচেষ্টা এবং নবীজী (সা.) কে চিরতরে নিচিহ্ন করার অশুভ চক্রান্ত। প্রত্যক্ষ কারণ ছিল, নাখলার ঘটনা, কাফেরদের রণপ্রস্তুতি, আবু সুফিয়ানদের অপপ্রচার মক্কাবাসীদের ক্ষোভ ও যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য ওহী লাভ। এসব কারণে আবু জাহালের নেতৃত্বে ১০০০ সৈন্য নিয়ে মদীনা আক্রমণের সংবাদ শুনে এদের প্রতিহত করতে ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে ১৬ই মার্চ অর্থাৎ ১৭ই রমজান ৩১৩ জন মুজাহিদ (৬০ জন মুহাজির এবং অন্যরা আনসার) নিয়ে মদীনা শরীফের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে আশি মাইল দূরে বদর নামক স্থানে রাসূল (সা.) এর নেতৃত্বে এ রক্তক্ষয়ী জিহাদ সঙ্ঘটিত হয়েছিল। বদর যুদ্ধের সফলতা হচ্ছে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি, বিশ্ব বিজয়ের সূচনা, সর্বোত্তম ইতিহাস সৃষ্টি, প্রথম সামরিক বিজয়, কুরাইশদের শক্তি খর্ব, ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন, নব যুগের সূচনা, চুড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারক যুদ্ধ, রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি স্থাপন, জিহাদের অনুপ্রেরণা, বীরত্বের খেতাব লাভ, পার্থিব শক্তির ভিত্তি স্থাপন, ইসলাম ও মহানবী (সা.) এর প্রতিষ্ঠা, সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য সৃষ্টি, মিথ্যার উপর সত্যের জয়, সূরা আনফালে ঘোষিত আল্লাহ তা’আলার ওয়াদা পূরণ, রাসূল (সা.) দোয়া কবুল হওয়া, বদর জিহাদে মুসলমানদের পক্ষে আল্লাহ তা’আলার গায়েবী সাহায্যের জ্বলন্ত প্রমাণ। বদর জিহাদের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হচ্ছে: বদর জিহাদে অংশগ্রহণকরী সাহাবীগণের মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ে নেতৃত্বদানকারী ছিলেন হযরত উমর (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত আমীর হামজা (রা.)। কাফেরদের নেতৃত্বে ছিল আবু জাহাল, উতবা, শায়বা, নজর ইবনে হারেস, ওয়ালীদ বিন মুগীরা ও আবু সুফিয়ান। সাহাবাগণের (রা.) পক্ষ থেকে প্রথম তীর নিক্ষেপকারী সাহাবী ছিলেন হযরত সা’দ ইবনে ওয়াক্কাস (রা.)। বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের মধ্যে দু’জন ছিলেন উষ্ট্রারোহী, ৮০ জন তলোয়ারধারী, অবশিষ্টগণ ছিলেন তীর ও বর্শাধারী। এই জিহাদে আল্লাহ তা’আলা ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য প্রদান করেন। জিহাদের বদর প্রান্তরে পূর্ব রাতে প্রবল বৃষ্টির কারণে কাফেরদের এলাকা কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল হয়ে যায়। সাহাবাগণের বালুময় অবস্থানস্থল শক্ত হয়ে যায় এবং পানি সংগ্রহের সুযোগ হয় এবং খেজুরের ডাল তলোয়ারের মত ধারালো হয়ে যাওয়ায় কাফেরদের কতল করাও সহজ হয়। নবীজি (সা.) সৈন্যবাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আবেগময়ী ভাষণ দিচ্ছেন। একপর্যায়ে বলছেন, ওই জান্নাতের দিকে ছুটে আসো যা আসমান ও জমিনের চেয়েও বড়। ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করে শহীদ হলে এমন দশটি পৃথিবীর সমান একটি জান্নাত তোমাকে দেয়া হবে। পাশেই একজন সাহাবি খেজুর খাচ্ছিলেন। যখন জান্নাতের কথা শুনলেন, তখন বললেন, বাহ! কী চমৎকার জান্নাত বানিয়ে রেখেছেন আল্লাহতায়ালা। আমি যদি হাতে থাকা খেজুরগুলো খেতে থাকি তাহলে তো জান্নাতে যেতে খুব দেরি হয়ে যাবে। এই বলে হাতের সব খেজুর ছুড়ে ফেলে তক্ষুণি চলে যান জিহাদের ময়দানে। জগতের মানুষ ভরসা করে জাগতিক উপকরণের ওপর। মুমিন ভরসা করে আল্লাহর ওপর। তাই তো রাসূল (সা.) যুদ্ধ শুরুর প্রারম্ভে আকাশের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বারবার বলছিলেন, হে আল্লাহ! এত বিশাল সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করার শক্তি এ ছোট্ট মুমিন বাহিনীর নেই। আজ যদি এ মুমিন বাহিনী হেরে যায়, তাহলে তোমাকে আল্লাহ বলে ডাকার আর কেউই থাকবে না। এভাবে দোয়া শেষ করে রাসূল (সা.) নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন যুদ্ধের ময়দানে। আর তক্ষুণি আল্লাহর সাহায্য নেমে এলো। বিশ্বাসীরা জয়ী হলেন। আজকের মুসলমানের দিকে তাকালে দেখা যায়, ধনে-জনে, জ্ঞান-গরিমায় পিছিয়ে নেই তারা। নবীজির জামানায় না ছিল ধন, না ছিল জনবল, ছিল না কোনো ডক্টরেট-মাস্টার্স করা উচ্চশিক্ষিতের ছড়াছড়ি।