সিরাজুল ইসলাম ২ নভেম্বর ২০২৪ , ৬:৩৪:১৭ অনলাইন সংস্করণ
গত ৫ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর দুই হাজার ১০টি হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করা হয় বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে।
এসবের মধ্যে এক হাজার ৭৪৪টি ঘটনা ইতোমধ্যে যাচাই-বাছাই করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। যাচাইকালে দেখা যায়, ৯০ ভাগ অভিযোগের সঙ্গেই ধর্মীয় বিষয় জড়িত নয়। ঘটনাগুলো ঘটেছে কেবল রাজনৈতিক কারণে।
এসব ঘটনায় ৩৬টি মামলা হয়েছে। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে ৬৩৬টি। আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন এক হাজার ৭২টি। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর একের পর এক নির্যাতন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। শুধু তাই নয়, বিষয়টি নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে লিখিত অভিযোগ দেয় সংগঠনটি।
অভিযোগ দেওয়া হয় জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দপ্তরেও। নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদে আজ শনিবার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে গণসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে সংখ্যালঘু ঐক্যজোটের ব্যানারে।
এদিকে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের যেসব অভিযোগ উঠেছে সেগুলোর তদন্ত করে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই হাজার ১০টি অভিযোগের মধ্যে এক হাজার ৪৮৪টি ঘটনাই ঘটেছে ৫ আগস্ট, যেদিন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের দাবি করা হত্যাকাণ্ড এবং ধর্ষণের ঘটনা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট।
তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নয়টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে তিনটিই ঘটেছে ৫ আগস্ট। এগুলো হয়েছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। অন্য ছয়টি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের মধ্যে একজন মারা গেছেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। জমিজমার বিরোধ, অর্থ লেনদেন ও পূর্বশত্রুতার জেরে তিনজন নিহত হয়েছেন। আর ৪ আগস্ট নিহত হন দুজন। এই দুজন মৃত্যুবরণ করেন তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে। তাই এগুলোকে সাম্প্রদায়িক ঘটনা হিসাবে বিবেচনা করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধর্ষণের চারটি অভিযোগ করা হলেও দুটি অভিযোগ একেবারেই বানোয়াট। একটি অভিযোগের ক্ষেত্রে নগদ টাকা, মালামাল ও স্বর্ণালংকার লুটের প্রমাণ পাওয়া গেলেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। আর অন্য একটি ঘটনা ঘটেছে গত ৪ আগস্ট রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এবার সারা দেশে ৩২ হাজার ৬৬৬ মণ্ডপে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজা উদযাপিত হয়। এগুলোর মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে ৪৯টিতে। অপ্রীতিকর ঘটনার মধ্যে আছে পাঁচটি চুরি ও ১২টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা। অন্যান্য ৩২টি ঘটনার মধ্যে রয়েছে মণ্ডপের লাইট ভাঙচুর, ইট-পাথর নিক্ষেপ, দস্যুতা, মারামারি, চাঁদাবাজি, মদ্যপান, খড়ের গাদায় আগুন, ককটেলসদৃশ বস্তু উদ্ধার, ব্যানার ছেঁড়া, উচ্ছৃঙ্খলতা, চিরকুট পাঠানো, মণ্ডপে ইসলামি সংগীত পরিবেশন, ভীতি প্রদর্শন, প্রতিমার মালা খুলে ফেলার চেষ্টা, সন্দেহজনক ঘোরাঘুরি প্রভৃতি।
এসব ঘটনায় ১৮টি মামলা ও ৩০টি জিডি হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ২৯ জনকে। এর মধ্যে হাতেনাতে গ্রেফতার হন ১৯ জন। পূজাকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নয়টি অপপ্রচারের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় দুটি মামলা ও একটি জিডি করা হয়। আর গ্রেফতার করা হয় চারজনকে।
দুর্গাপূজাকে ঘিরে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনাগুলোর প্রত্যেকটির প্রাথমিক তদন্ত শেষে পুলিশ সদর দপ্তরে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলো। প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৩ অক্টোবর চাঁদপুর সদরের ঘোষপাড়া পূজামণ্ডপে জয় এবং সৌরভ নামের দুই ব্যক্তি মদ্যপ অবস্থায় যান। এ সময় গান-বাজনা ও আনন্দ-উৎসবের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে দর্শনার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। দায়িত্বরত পুলিশ ও আনসার সদস্যরা তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ওইদিন চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালি থানা এলাকার এনায়েত বাজার পূজামণ্ডপে মোবাইল হারানোকে কেন্দ্র করে মারামারির ঘটনা ঘটে। পরে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ১২ অক্টোবর গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বানিয়ারচর দক্ষিণপাড়া গ্রামে মন্দিরের পাশে কে বা কারা গণেশ পাগলের মূর্তির মাথা ভেঙে মূর্তির পাশে রেখে দেয়। এ ঘটনায় ওইদিনই সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি করা হয়।
গত ১২ অক্টোবর আরও যেসব জায়গায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, রংপুরের গংগাচড়া, ঠাকুরগাঁও সদর, লক্ষ্মীপুর সদর, বরগুনার বামনা, মানিকগঞ্জের সিংগাইর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর। এগুলোর মধ্যে হাজীগঞ্জ মধ্যবাজারে শ্রী শ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়া মন্দিরে ইটের টুকরো নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। গংগাচড়া পুটিমারী বড়বাড়ি সার্বজনীন দুর্গা মন্দির থেকে দেড়শ গজ দূরে স্থানীয় প্রভাত চন্দ্র ও অধীর চন্দ্র রায়ের পৃথক দুটি খড়ের গাদায় কে বা কারা আগুন দেয়। সাংবাদিক না হয়েও সাংবাদিক পরিচয়ে ঠাকুরগাঁও সদরের বাকুন্দা পূজা মণ্ডপে গিয়ে চার ব্যক্তি চাঁদা দাবি করেন। লক্ষ্মীপুর সদরের রাধামাধব সেবাশ্রম মন্দিরের মূল ফটকের সামনে থেকে চাকুসহ ফাহিম নামের এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাঞ্ছারামপুরের পূজামণ্ডপে গিয়ে চাঁদা দাবি করেন তিন হিজড়া। মানিকগঞ্জের সিংগাইরের পূজামণ্ডপে পুরস্কার দেওয়াকে কেন্দ্র করে সভাপতি ও সহসভাপতির মধ্যে তর্ক-বিতর্ক, হাতাহাতি ও কিলঘুষির ঘটনা ঘটে।
গত ১১ অক্টোবর রাজধানীর কোতোয়ালির তাঁতীবাজার ১৭ নম্বর পূজামণ্ডপে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে চারজন আহত হন। ওইদিন আরও যেসব স্থানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে সেগুলোর মধ্যে আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, ঢাকার আশুলিয়া, পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া, পাবনার চাটমোহর, বাগেরহাটের মোল্লারহাট, বরিশালের অগৈলঝাড়া (পৃথক দুটি মণ্ডপে), মৌলভীবাজার সদর, দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী, রাজশাহীর বোয়ালিয়া, সাতক্ষীরা সদর এবং চুয়াডাঙ্গার জীবননগর। ১০ অক্টোবর যেসব স্থানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে সেগুলো হলো-লালমনিরহাটের আদিতমারী, কুমিল্লার বরুড়া, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, বরগুনার বামনা, চট্টগ্রাম মহানগরীর জেএমসেন পূজামণ্ডপ, বরিশালের উজিরপুর এবং কুড়িগ্রামের রাজারহাট। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অলোচিত ঘটনা ছিল চট্টগ্রাম মহানগরীর জেএমসেন পূজামণ্ডপে নাথ/গজল পরিবেশনা ও পরবর্তীকালে উত্তেজনা।
এছাড়া ১ থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের যেসব এলাকার পূজামণ্ডপে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে সেগুলোর মধ্যে আছে-কিশোরগঞ্জ সদর, কুমিল্লার বরুড়া, ভোলা সদর, রংপুরের গংগাচড়া, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, সাতক্ষীরার আশাশুনি, রাজবাড়ীর সদর ও কালুখালী, খাগড়াছড়ির রামগড়, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, নীলফামারীর ডিমলা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, বরিশালের বাকেরগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ সদর, সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজার, নড়াইল সদর, পাবনার সুজানগর, রংপুর কোতোয়ালি এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ। এসব ঘটনাগুলোর মধ্যে সুজানগরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনাটি ছিল বেশ আলোচিত।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর একটি মহল বিশেষ উদ্দেশ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির চেষ্টা চালিয়েছিল। ওই চক্র শারদীয় দুর্গাপূজাকে ঘিরেও অপপ্রচার চালিয়েছে। কিন্তু শান্তিপূর্ণভাবেই পূজা শেষ হয়েছে। বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। সারা দেশে মাত্র ৪৯টি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার যেসব অভিযোগ এসেছে সেগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি নিয়ে যদি কেউ বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করে তাহলে তাকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনিন্দ্র কুমার নাথ বলেন, কে কোন দল করে সেটা দেখার বিষয় নয়। যে পরিবার আক্রমণের শিকার হয়েছে, সে পরিবারের একজন হয়তো রাজনৈতিক দল করে। কিন্তু পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে পুরো পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটা কাম্য হতে পারে না। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, রাজনীতি করলেই মেরে ফেলতে হবে? এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ধর্ষণের বিষয়ে কেউ সরাসরি আমাদের কাছে অভিযোগ করেনি। পত্রপত্রিকায় আসা অভিযোগের ভিত্তিতে বিষয়টি কম্পাইল করেছি। ধর্ষণ যদি নাও হয়ে থাকে শ্লীলতাহানি তো হয়েছে। এর বিচার করতে হবে। আমাদের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যুগ যুগ ধরেই আমরা বৈষম্যের শিকার। আমাদের চলমান আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী। আমাদের দাবি সমতার দাবি। দাবি বাস্তবায়ন না হলে ২ অক্টোবরের গণসমাবেশ থেকে কঠোর কর্মসূচি আসতে পারে বলে তিনি জানান।