সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি ২১ অক্টোবর ২০২৪ , ১১:৩০:২৪ অনলাইন সংস্করণ
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন রেজা (৫৫) কে আটক করেছে পুলিশ। সোমবার (২১ অক্টোবর) সন্ধ্যায় সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাজমুল হক,এসআই মহিন উদ্দিন ও এসআই উজ্জল মিয়ার নেতৃত্বে একদল পুলিশ শহরের উকিলপাড়াস্থ রেজা ম্যানশন মার্কেট থেকে তাকে আটক করেন।
জানা যায়,সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার অন্তর্গত সুরমা ইউনিয়ন শাখার সভাপতি মোঃ ফিরোজ মিয়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেট,জেলা পুলিশ সুপার ও সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ বরাবরে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। দায়েরকৃত ঐ অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন,আমির হোসেন রেজা একজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা,জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কার্যকরী কমিটির সদস্য, সদর থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সেক্রেটারী ও মহকুমা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ছাড়াও একাধিক মামলার আসামী।
সুনামগঞ্জ সদর থানার মামলা নং ১৮ (জিআর ১৬৯/২০০৬ইং) তাং ১৯/০৭/২০০৬ইং ধারা ১৪৩/৪৪৭/৩২৩/৩২৪/৩৭৯/৪২৭/৩০৭/৫০৬/৩৪ দ:বি: আইনের মামলায় এজাহারভূক্ত প্রধান আসামী ছিলেন তিনি।
গ্রামের নিরীহ নাগরিক আশিক মিয়াকে মারপিট করিলে উক্ত আমির হোসেন রেজার বিরুদ্ধে আমল গ্রহণকারী জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত সদর জোনে সিআর-২২৪/২০২৪ নং মামলা দায়ের হয়। উক্ত মামলায় তার বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালত, গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন। গত ২/৬/২০২৪ইং তারিখে বিজ্ঞ আদালত প্রেরিত গ্রেফতারী ওয়ারেন্ট সদর মডেল থানায় থাকার পরও তাকে গ্রেফতার না করায় ঐ মামলার পলাতক আসামী হওয়া স্বত্তেও বাদীর সাথে আপোস নিস্পত্তি করে গ্রেফতার অভিযান হইতে আর্থিক দাপট ও দলীয় প্রভাবে আত্মরক্ষা করেন। আইনের কাছে পলাতক থাকাবস্থায় তিনি গত সরকারের মন্ত্রী ও র্যা বের মহাপরিচালকের সাথে ত্রাণ বিতরন কার্যক্রমে অংশ নিয়ে ফটোসেশন করেন।
আমির হোসেন রেজার বিরুদ্ধে সরকারী খাস খতিয়ানের জায়গা হতে ৫ লাখ ঘনফুট মাটি (যাহার মূল্য এক কোটি টাকা) চুরির ঘটনায় সদর উপজেলা ইউনিয়ন সহকারী ভুমি কর্মকর্তা মোঃ নুর আলী বাদী হয়ে জিআর মামলা নং ৪৭/২০২৪ইং (সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানার মামলা নং ২০ তাং ১৫/০২/২০২৪ইং) দায়ের করেছেন। উক্ত মামলায় সদর মডেল থানার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই রিয়াজ উদ্দিনের দাখিলকৃত অভিযোগপত্র নং ৮৭ তাং ৩১/০৩/২০২৪ইং ধারা ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২৩ইং এর ১২ ও ১৩ ধারা,বিজ্ঞ আদালত গ্রহন করে ঐ মামলাটিকে বিচারের জন্য বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।
আমির হোসেন রেজা ইতিপূর্বে সুনামগঞ্জ মহকুমা যুবলীগের সভাপতি,পরবর্তীতে সুনামগঞ্জ সদর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৮/০৩/১৯৯৭ইং তারিখে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও তৎকালীন মন্ত্রী আমির হোসেন আমু,প্রেসিডিয়াম সদস্য ও তৎকালীন মন্ত্রী তোফায়েল আহমদ,প্রেসিডিয়াম সদস্য ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মোহাম্মদ মনসুর এর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে গঠিত ৩১ সদস্য বিশিষ্ট কার্যকরী কমিটির ৩১ নং কার্যকরী সদস্য ছিলেন তিনি।
একজন অতি সুবিধাভোগী প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে উক্ত আমির হোসেন রেজা ও তার সহযোগী সঞ্জয় পালগং,গত ৪ আগস্ট ২০২৪ইং রবিবার সুনামগঞ্জ শহরের পুরাতন বাস স্টেশনে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সসস্ত্র সন্ত্রাসীগণ কর্তৃক বিএনপি দলীয় বহু নেতাকর্মীকে রামদা দিয়া কোপিয়ে গুরুতর জখম ও জেলা বিএনপির কার্যালয় ভাংচুরের ঘটনায় স্বশরীরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলেও ঐ অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
এই অবস্থায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে উক্ত আমির হোসেন রেজাকে সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানার রুজুকৃত দ্রæতবিচার আইনের মামলা নং ৫ তাং ৪/৯/২০২৪ইং এর আসামী হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করত: তদন্তপূর্বক তার সম্পৃক্ততা প্রমাণের জন্য অভিযোগকারী বিএনপি নেতা ফিরোজ মেম্বার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ প্রদান করেন।
এর আগে গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পরিষদের ৯ জন সদস্য পরবর্তীতে ১১ জন সদস্য দুদফায় তার বিরুদ্ধে একটি লিখিত অনাস্থা অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগে তারা উল্লেখ করেন আমির হোসেন রেজা গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরিষদে অনুপস্থিত রয়েছেন। বর্তমানে তিনি আত্মগোপনে থাকায় পরিষদের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ নাগরিকরা। নিয়মিত তিনি অনুপস্থিত থাকলেও সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে কোনও ছুটি নেননি। ওই অভিযোগে ইউপি সদস্যরা উল্লেখ করেন গত ১০ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার শাখায় ৫৮৯ নং স্মারকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সহকারি কমিশনারকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
অভিযোগকারীরা জানান, নির্বাচিত ইউপি সদস্যদের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেতাই ভাবে বরাদ্দ বণ্ঠনসহ নিজের পছন্দের লোকদের দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। বিভিন্ন সময়ে ভূয়া প্রকল্প দিয়েও বরাদ্দ নয়ছয় করছেন। এতে বঞ্চিত হয়েছেন ইউনিয়নবাসী।
২০২২ সালের ৫ জুন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর দেওয়া আবেদনে ইউপি সদস্যরা উল্লেখ করেন, নির্বাচিত ইউপি সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় না করে ইউনিয়নের সকল প্রকল্পে নিজেই কাজ করছেন। কাবিখা, কাবিটা, এলজিএসপি-২ এর বরাদ্দ ৪ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা ইউপি সদস্যদের না জানিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করেন সদস্যরা। এর আগে ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে আরেকটি অভিযোগ দেন সদস্যরা। সেখানে তারা ইউনিয়নের বরাদ্দকৃত ১০টি নলকূপ, ২টি লেট্টিন অনিয়মের মাধ্যমে সদস্যদের না জানিয়ে মনগড়া বিতরণ করেন বলে অভিযোগ করেন। রাস্তার কাজে নিয়োজিত মহিলা কর্মী নিয়োগেও তিনি সদস্যদের না জানিয়ে সুবিধা নিয়ে নিয়োগ দিয়েছেন মর্মে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর আলাদা অভিযোগ করেন। গত ২৭ জুলাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর আরেকটি লিখিত অভিযোগ করেন ভিজিডির চাল আতœসাতকৃত হতদরিদ্র নারী মালেহা খাতুন। অভিযোগে তিনি ইউপি চেয়ারম্যান আমির হোসেন রেজা তাকে ১৫ মাসের ভিজিডির চাল কম দিয়েছেন বলে জানান।
অভিযোগকারীদের মধ্যে ইউপি সদস্য আব্দুল হাই ও ইউপি সদস্য খোরশিদ মিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন রেজা নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই প্রকল্প বণ্ঠনে বৈষম্য করছেন। ইউপি সদস্যদের পাশ কাটিয়ে বরাদ্দ বণ্ঠনের নামে লোপাট করছেন। আমরা তার বিরুদ্ধে সবাই মিলে অনাস্থা দিয়েছি। একাধিক অভিযোগ করেছি উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে।
অণাস্থাপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান আমির হোসেন রেজার বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসার এনামুর রহীম বাবর গত ১৪ বছর ধরে একই কর্মস্থলে রয়েছেন। অনাস্থা অভিযোগের তদন্তের নামে তিনি প্রায় ৩ মাস সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত চেয়ারম্যানকে কোন নোটিশ প্রদান করেননি। অভিযোগ উঠেছে একজন মহিলা উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে বিদেশী স্বর্ণালংকার উপঢৌকন দিয়ে এবং দুর্নীতিবাজ তদন্ত কর্মকর্তা এনামুর রহীম বাবরকে মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে নিজের চেয়ার ধরে রাখেন আমির হোসেন রেজা। কথিত আছে আপন ভাই আফজাল হোসেন ছানা ও ভাতিজা তাজুয়ার আফজাল শিহাবকে দিয়ে বাপপুতের পিআইসি বানিয়ে গত ৩ বছরে শিললুয়ার হাওরে পাউবো প্রকল্পের কাজ ভাগিয়ে সরকারের বরাদ্দকৃত মোটা অংকের টাকা পকেটস্থ করেছেন ঐ চেয়ারম্যান। অন্যদিকে প্রকল্পের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার পরও ইউপি মেম্বার আব্দুল হাই চেয়ারম্যানের কাছে মারাত্মকভাবে প্রতারিত হন।