ভাটি বাংলা ডেস্কঃ ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ১:৫৭:২৭ অনলাইন সংস্করণ
কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনার পালানোর পর ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মাত্র ২০ দিন পেরিয়েছে। এর মধ্যেই অর্থনীতিতে বইতে শুরু করেছে সুবাতাস।
মিল-কারখানার চাকা ঘুরছে, রেমিট্যান্স আসছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ বাড়ছে, শেয়ারবাজার চাঙ্গা হয়েছে, ব্যাংকিং সেক্টরে নতুন হাওয়া লেগেছে। তৈরি পোশাক থেকে শুরু করে সব ধরনের ব্যবসায়ী ও শিল্পমালিকরা জানিয়েছেন তারা ব্যবসা-বাণিজ্যে আস্থাশীল হয়ে উঠছেন।
তবে পরিবহন যোগাযোগের কিছু সমস্যা সমাধানের কথা বলছেন। অথচ এক মাস আগেও চরম বিপর্যয়ের মুখে ছিল দেশের অর্থনীতি। ডলার সংকটে রিজার্ভ ঠেকেছিল তলানিতে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, মহামারির মধ্যে ওই সময় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছিলেন প্রবাসীরা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনীতি চাঙ্গায়ও প্রবাসীরা বিশেষ ভূমিকা রাখবেন।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙ্গা হয়েছে। সেখানে কর্মরত আমাদের প্রবাসীরা বেশি আয় করছেন। দেশেও বেশি টাকা পাঠাতে পারছেন। দেশে ডলারের সঙ্কট চলছে। মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা চলছে। রিজার্ভ কমছে। এই মুহূর্তে রেমিট্যান্স বাড়া অর্থনীতির জন্য খুবই ভালো হবে।
আওয়ামী দুঃশাসনে গত ১৫ বছরে ব্যাংক লুট, অর্থপাচার, ঘুষ-অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত ছিল দেশ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভারতে পালানোর পর অন্তর্বর্তী সরকারের নানামুখী তৎপরতায় সকল সিন্ডিকেট ভেঙে যাওয়ায় অর্থনীতিতে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে পণ্যমূল্য থেকে শুরু করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় অনেকটা স্বস্তি ফিরেছে। পরিবহনে চাঁদাবাজি, মোড়ে মোড়ে সার্জেন্টদের চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে।
বন্যার কারণে ঢাকা-চটগ্রাম হাইওয়েতে গাড়ি চলাচলে কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে। দেশের ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিনের অস্থিতিশীলতা ফেরাতে অর্থ লোপাটকারী বা পাচারকারীদের শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেক ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে দেয়া হয়েছে।
অনেকগুলোতে নতুন করে বোর্ড গঠন করা হয়েছে। ব্যাংকের প্রতি আমানতকারীদের আস্থা ফেরানোতে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিনে আর্থিক খাতে যেসব অনিয়ম হয়েছে তা চিহ্নিত করতে অনিয়ম-দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশে কমিটি করা হয়েছে। গভর্নর থেকে শুরু করে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক ও দুর্নীতিবাজদের অপসারণ করে নতুন করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় মদদে বিভিন্ন বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠীর লাখ লাখ কোটি টাকা পাচারের অর্থ ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন সংস্থা ও দেশের সহযোগিতা নেয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গণমাধ্যমে দেওয়া ভাষণে জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি নামে-বেনামে ঋণের নামে কত টাকা আত্মসাত করে পাচার করেছেন, তার হিসাব করা হচ্ছে। কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অবৈধভাবে পাচারকৃত অধিকাংশ টাকা এই বছরের মধ্যে উদ্ধার করতে পারবে বাংলাদেশ। দীর্ঘদিন পর শেয়ারবাজারের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরছে।
ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে এক বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তার মৌখিক সম্মতি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। অবশ্য অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বাংলাদেশকে আরও তিন বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা অনুমোদনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) খুবই ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে।
এদিকে দেশের অনেক এলাকায় বন্যা চলছে। তারপরও দুই-একটি পণ্য ছাড়া বাড়েনি খাদ্যদ্রব্যের দাম। বরং বড় ধাপে কমেছে। আরও বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম কমার তালিকায় যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ইতোমধ্যে ডলারের আকাশছোঁয়া মূল্য ১২০ টাকায় স্থিতিশীল পর্যায়ে আছে। বেড়েছে রেমিট্যান্সের গতি প্রবাহ। আমদানিতে এলসি আগের চেয়ে স্বাভাবিক হয়েছে। অধিকাংশ এলসিই খোলা হচ্ছে। দেশ গঠনে প্রবাসীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে রেমিট্যান্স বেড়েছে। হাসিনা পালানোর মাসে অস্থিরতার মধ্যেও হু হু করে বেড়েছে রেমিট্যান্স।
এরই ধারাবাহিকতায় সদ্য বিদায়ী আগস্ট মাসে দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স এসেছে ২২২ কোটি (২ দশমিক ২২ বিলিয়ন) ডলার। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে) যার পরিমাণ ২৬ হাজার ৬৪০ কোটি টাকার বেশি। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান কমতে শুরু করেছে।
আর তাই আওয়ামী দুঃশাসনে বিরাজমান অস্থিতিশীলতার কালো মেঘ অনেকটা কেটে যাওয়ায় সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়ছে; দেশ ফের স্বস্তিতে ফিরছে। সরকারের নীতি-নির্ধারকদের দাবি, দেশে দীর্ঘদিন থেকে ডলার ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং এর প্রভাবে নিত্যপণ্যের বাজারে যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছিল, শিগগিরই তা অনেকাংশে কেটে যাবে।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাতসহ দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে শিগগিরই সুবাতাস বইবে। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপাকে ফেলতে দেশি-বিদেশি নানা চক্র দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার যে অপতৎপরতা চালাচ্ছে তাদের সে ষড়যন্ত্র পুরোপুরি নস্যাৎ করে দেওয়া সম্ভব হবে।
বিশ্লেষকরা জানান, হাসিনা সরকারের নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট বাণিজ্যে খাদ্যসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কশাঘাতে নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের যখন নাভিশ্বাস, ঠিক সেই দুঃসময়ে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
একই সঙ্গে ফিরছে রেমিট্যান্সের গতি, আমদানিতে এলসি খোলা স্বাভাবিক হচ্ছে। পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে। পণ্যের দাম কমছে। তাই আশাবাদী দ্রুতই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। সবকিছু স্থিতিশীল হবে। দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক মন্দা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের দূরদর্শী সিদ্ধান্তে আবারও আর্থিক খাতে সুবাতাস ফিরবে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, আর্থিক খাতে দীর্ঘদিন থেকে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিশেষ করে গার্মেন্টসে শ্রম অসন্তোষ এবং এখনো একটি বহিরাগত চক্র অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে।
ইতোমধ্যে এই চক্রের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আশা করি দ্রুতই গার্মেন্টস খাতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রবাসীরা দেশ গঠনে রেমিট্যান্স পাঠানো বাড়িয়েছে।
এটা অবশ্যই আমাদের জন্য সুখবর। তবে রফতানি বাড়া পুরোটাই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, বায়ারদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার ওপর নির্ভর করে। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য পদক্ষেপ নিয়েছেন। পাশাপাশি দীর্ঘদিন দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে যে অস্থিতিশীল পরিস্থতি ছিল তা ইতোমধ্যে অনেকটা নিরসন হয়েছে।
এখন বায়ারদের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হলেই আশাবাদী দ্রুতই রফতানি বাড়বে। নতুন নতুন বায়ার আবার অর্ডার দেবে। দেশের আর্থিক খাতে স্বাভাবিকতা ফিরবে। পোশাক মালিকরাও চেষ্টা করছে বায়ারদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউজের সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ বায়ারস কাউন্সিলের সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেন বলেছেন, জ্বালানির দাম কমানো অবশ্যই দেশের জন্য ভালো সিদ্ধান্ত। তবে দেশে দ্রুত বিদ্যুতের ঘাটতি মেটানো না গেলে অদূর ভবিষ্যতে দেশের সিংহভাগ শিল্প-কারখানা মুখ থুবড়ে পড়বে।
এ খাতের বিনিয়োগ আকর্ষণেও বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বিদ্যুৎ সংকট, যেটি এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। উৎপাদন খাত সমৃদ্ধ করতে ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, আমাদের যে সক্ষমতা আছে, তা থেকেই সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করাকে এমন সংকটাপন্ন সময়ে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত বলে মনে করেন।
সূত্র মতে, হাসিনার ভারতে পালানোর পর দেশের আর্থিক খাতে আগের সিন্ডিকেট চরম অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের দক্ষ হস্তক্ষেপে যার অনেকটাই ইতোমধ্যে সামাল দেওয়া গেছে। এতে সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা যেমন বেড়েছে, তেমনি দেশের মানুষের মধ্যে স্বস্তিও ফিরছে।
শিল্প মালিকরা জানান, গ্যাস ও বিদ্যু সঙ্কটে গত কয়েক মাসে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানার উৎপাদন ২০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। তাতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। চলতি মাসের প্রথম ভাগেও এ অবস্থা চলমান ছিল। হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর আবার ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থিতিশীলতা ফিরেছে।
ব্যবসায়ীরা অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানির দাম কমানোয় সরকারকে সাধুবাদ জানান। পাশাপাশি দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি পরিকল্পনা করে শিল্প এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কট নিরসনের তাগিদ দেন।
শিল্প মালিকরা আশাবাদী, গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ আরও খানিকটা স্বাভাবিক হলে দীর্ঘদিন অস্থিতিশীল বা সংকটকালীন সময়ের ঘাটতিও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। আর বস্ত্র ও গার্মেন্ট শিল্প নতুন করে চাঙ্গা হয়ে উঠলে দেশের অর্থনৈতিক মন্দা অনেকাংশেই কেটে যাবে।