• জাতীয়

    নির্বিচারে গুলি চালানো ও হুকুমদাতা পুলিশ কর্মকর্তারা এখনো অধরা

    ছাত্র-জনতা হত্যা মামলার আসামি হলেও দেখার কেউ নেই

      ভাটি বাংলা ডেস্ক: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ২:৫০:৩১ অনলাইন সংস্করণ

    ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালানোর সাথে জড়িত ও হুকুম দাতা পুলিশ কর্মকর্তারা এখনও অধরা।

     



    সাবেক দু’জন আইজিপি ও একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গ্রেফতার হলেও রহস্যজনক কারনে ৯৪ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। সর্বশেষ বুধবার রাতে গ্রেফতার করা হয় ডিএমপির সাবেক পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়াকে। অথচ এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে।



     

    ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে মধ্য জুলাই থেকে শুরু করে ৫ আগস্ট পর্যন্ত নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় অসংখ্য ছাত্র-জনতা। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর থেকে সাবেক মন্ত্রী-এমপি, নেতাকর্মী, পুলিশ, বিচারক ও আমলাদের বিরুদ্ধে শুরু হয় মামলা।

     



    গত রোববার পর্যন্ত শুধু ঢাকায় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২৯৪টি। এর মধ্যে বর্তমান ও সাবেক শতাধিক পুলিশ সদস্যের নাম রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, আন্দোলনে গুলি করে লাশ ফেলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছেন শতাধিক পুলিশ সদস্য।



     

    খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট বিকেলেও রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, গাজীপুর জেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় বেপরোয়া পুলিশ সদস্যদের নেতৃত্বে নির্বিচারে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো হয়। আন্দোলন দমাতে শেখ হাসিনা সরকার দফায় দফায় ইন্টারনেট বন্ধ করে, যাতে ওই সময়ে পুলিশ সদস্যদের বেপরোয়া তান্ডব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ না পায়। স¤প্রতি পর্যায়ক্রমে সেসব নৃশংস হত্যাকান্ডের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে শুরু করেছে। পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা কিছু মামলার এজাহার এবং ওই সময়ের ঘটনার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশের তান্ডবের বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে।

    পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে, মামলার সংখ্যা ৩৮টি।

     

    এর পরের অবস্থানে রয়েছেন পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৩৬টি। সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা ৩৩, ডিএমপি সাবেক যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের বিরুদ্ধে ২৭, স্পেশাল ব্রাঞ্চের সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ১১, ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের সাবেক ডিসি ইকবাল হোসাইনের নামে ৮, সাবেক যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার এস এম মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধেও ৮ ও র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে হয়েছে ৫টি মামলা। মামলাগুলোর মধ্যে অধিকাংশই হত্যা মামলা রুজু হয়েছে। মামলায় নাম রয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, সহকারী পুলিশ কমিশনার, একাধিক থানার ওসি, ইন্সপেক্টর, এসআই ও কনস্টেবলদেরও। সর্বোচ্চ মামলা হয়েছে যাত্রাবাড়ী থানায় ৯১টি।

     

    সরকার পতনের পর ভাইরাল এক ভিডিওতে দেখা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করা নিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামালকে ব্রিফ করছেন ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন। তার মোবাইলে একটি ভিডিও দেখিয়ে তিনি বলছিলেন, গুলি করে লাশ নামানো লাগছে স্যার। গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না। এইটা হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার বিষয়। এ সময় সেখানে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও উপস্থিত ছিলেন।

     

    গত ৫ আগস্ট দুপুরের পর ঢাকার আশুলিয়া থানার প্রধান ফটকসংলগ্ন স্থানে একটি ভ্যানে রাখা ছিল বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীর গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ। ওই ভ্যানেই হাত-পা ধরে পুলিশকে আরেকটি লাশ তুলতে দেখা যায়। সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল এ সংক্রান্ত ভিডিও। পরে ভিডিওটি তদন্তে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে।

     

    সূত্র আরও জানায়, সাবেক আইজিপি শহীদুল হকের বিরুদ্ধে সাতটি, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমদের বিরুদ্ধে ৩টি, সাবেক সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়ার বিরুদ্ধে দুটি, পুলিশ হেডকোয়ার্টারের অতিরিক্ত আইজি খন্দকার লুৎফুল কবির ও জামিল আহমেদের বিরুদ্ধে একটি, র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক এম খুরশিদের বিরুদ্ধে একটি, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তারের (অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) বিরুদ্ধে ছয়টি, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে একটি, সাবেক সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে তিনটি, সিটিটিসির সাবেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুটি, সাবেক ডিআইজি রিপন সরদারের বিরুদ্ধে একটি, সাবেক ডিআইজি খালিদ হাওলাদারের বিরুদ্ধে একটি, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়াদ্দারের বিরুদ্ধে একটি, ডিএমপি সাবেক যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের বিরুদ্ধে ২৭টি, সাবেক যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার এস এম মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে ৮টি, সাবেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে একটি ও সঞ্জিত কুমার রায়ের বিরুদ্ধে একটি, রংপুর রেঞ্জের সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি রশিদুল হকের বিরুদ্ধে একটি, ঢাকা রেঞ্জের সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি মারুফ হোসেন সরদারের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে।

     

    রমনা বিভাগের সাবেক ডিসি মোহাম্মদ আশরাফ ইমামের বিরুদ্ধে একটি, ডিএমপির সাবেক ডিসি তানভির সালেহীন ইমনের বিরুদ্ধে একটি, গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের সাবেক ডিসি মশিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুটি, সাবেক ডিসি মাহফুজুল আল রাসেলের বিরুদ্ধে একটি করে মামলা, সিটিটিসির সাবেক ডিসি জাহিদ তালুকদার, উত্তরার সাবেক ডিসি আশরাফুল আজিমের বিরুদ্ধে দুটি, তেজগাঁও বিভাগের সাবেক ডিসি এইচ এম আজিমুল হক ও হাফিজ আল ফারুকের বিরুদ্ধে একটি, লালবাগের সাবেক ডিসি মাহাবুব-উজ-জামানের বিরুদ্ধে একটি ও লালবাগ বিভাগের সাবেক ডিসি জাফর হোসেনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে।

     

    অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা: ওয়ারী জোনের সাবেক এডিসি নুরুল আমিন, সবুজবাগ জোনের সাবেক এডিসি গোবিন্দ চন্দ্র, ডিবির সাবেক এডিসি শাহিন শাহ মাহফুজ, ডিএমপির সাবেক এডিসি হাফিজ আল আসাদ, কোতোয়ালি জোনের সাবেক এডিসি মুহিত কবির সেরনিয়াবাত, লালবাগ জোনের সাবেক এডিসি শহিদুল আসলাম, ডিবির সাবেক এডিসি জুয়েল রানা, হাসান আরাফাত, নাজমুল ইসলাম, মতিঝিল বিভাগের সাবেক এডিসি সাব্বির রহমান, ডিবির সাবেক এডিসি ফজলে এলাহী, মোহাম্মদপুর জোনের সাবেক এডিসি মো. রওশানুল হক সৈকত ও ওয়ারী বিভাগের সাবেক এডিসি শাকিল মোহাম্মদ শামীমের বিরুদ্ধে একটি করে মামলা হয়েছে। এছাড়া ডিবির সাবেক এডিসি আফজাল হোসেন টুটুলের বিরুদ্ধে রুজু হয়েছে দুটি মামলা। সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা: নিউমার্কেট জোনের সাবেক এসি রেফাতুল ইসলাম রিফাত, কোতোয়ালি জোনের সাবেক এসি শাহীনুর রহমান, পেট্রোল-মোহাম্মদপুরের সাবেক এসি মো. শহীদুল হক, মোহাম্মদপুর জোনের সাবেক এসি মিজানুর রহমান, ট্রাফিক-যাত্রাবাড়ী জোনের সাবেক এসি তানজিল আহমেদ ও মতিঝিল জোনের সাবেক এসি গোলাম রুহানীর বিরুদ্ধে একটি করে মামলা হয়েছে।

     

    ওসি পদমর্যাদার কর্মকর্তা: সাবেক ওসি মো. আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুটি, কোতোয়ালি থানার সাবেক ওসি শাহীনুর রহমান শাহীনের বিরুদ্ধে একটি, লালবাগ থানার সাবেক ওসি খন্দকার মো. হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে চারটি, আদাবর থানার সাবেক ওসি মাহাবুর রহমানের বিরুদ্ধে একটি, সাবেক ওসি ফরমান আলী, মোহাম্মদপুর থানার সাবেক ওসি মাহফুজুল হক ভুঁইয়া, রূপনগর থানার সাবেক ওসি শিকদার মো. শামীম হোসেন, দারুসসালাম থানার সাবেক ওসি মো. সেলিমুজ্জামান, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি মাহজার, মুগদা থানার সাবেক ওসি পলয় কুমার সাহা, নিউমার্কেট থানার সাবেক ওসি মো. আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে একটি করে মামলা এবং রামপুরা থানার সাবেক ওসি মসিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুটি মামলা রুজু হয়েছে।

     

    ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তা: কোতোয়ালি থানার ইন্সপেক্টর অপারেশন নাজমুল হাসান, ডিএসবির রণজিত রায়, কোতোয়ালি থানার ইন্সপেক্টর তদন্ত মেহেদী হাসান, বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ফাহেয়াত উদ্দিন রক্তিম, যাত্রাবাড়ী থানার ইন্সপেক্টর তদন্ত মো. জাকির হোসেন, সূত্রাপুর থানার তদন্ত মো. রবিউল ইসলাম, মোহাম্মদপুর থানার তদন্ত মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন, সিটিটিসির আবুল বাশাররের বিরুদ্ধে একটি করে এবং লালবাগ থানার অপারেশন মো. আতিকুল হকের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে।

     

    এসআই ও এএসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তা: কোতোয়ালি থানার মো. শাহাবুদ্দিন হাওলাদার, শাহবাগ থানার মো. শাহাদাৎ আলী, রামপুরা থানার কাউসার আহম্মদ খান, ডিএমপির নুরে আলম মিয়া, আদাবর থানার মাসুম বিল্লাহ, আদাবর থানার মো. রশিদ, কদমতলী থানার রাজীব চন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে একটি করে, শাহবাগ থানার আশরাফুল সিকদারের বিরুদ্ধে দুটি ও গুলশান থানার মো. মামুন মাতব্বরের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে। এছাড়া এএসআই পদমর্যাদার রায়েরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলমের বিরুদ্ধে রুজু হয়েছে একটি মামলা। কনস্টেবল: কোতোয়ালি থানার মো. মাহবুব আলম, মো. আব্দুর রশীদ ও রমজান মোল্লার বিরুদ্ধে একটি করে মামলা রুজু হয়েছে।

    সূত্রঃ ইনকিলাব।

    আরও খবর

    Sponsered content