ভাটি বাংলা ডেস্ক: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ৩:৪০:০০ অনলাইন সংস্করণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে মোবাইল চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
এতে নেতৃত্ব দেন ফজলুল হক মুসলিম হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক উপ-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জালাল আহমেদ।
তার সাথে আরো ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের আব্দুস সামাদ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সুলতান, গণিত বিভাগের রাব্বি, আহসান উল্লাহ, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ফিরোজ, মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের মোহাম্মদ সুমন, সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের ওয়াজিবুল, ফার্মেসি বিভাগের মোহাম্মদ ইয়ামুজ জামান, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের মোত্তাকিন সাকিন ও সাজ্জাদ।
এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- ছাত্রলীগ নেতা জালাল আহমেদ, মোহাম্মদ সুমন, মোত্তাকিন সাকিন ও সাজ্জাদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, যেটা ঘটেছে তা খুবই দুঃখজনক এবং অনাকাক্সিক্ষত। আমরা বিষয়টি জানতে পেরে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি।
কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে প্রাথমিকভাবে ৪ জনের সংশ্লিষ্টটা পেয়েছি। তাদেরকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।
তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া আরো বেশ কয়েকজন অভিযুক্তের ব্যাপারে তদন্ত চলমান বলে জানান প্রক্টর।
জানা যায়, গণপিটুনিতে নিহত তোফাজ্জল বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বাসিন্দা। ছাত্র জীবনে একসময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন তিনি।
স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের মেয়ের সাথে প্রেমঘটিত বিষয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে গত দুই বছর যাবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায় তাকে। মা বাবা কেউই বেঁচে নেই তোফাজ্জলের।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার সন্ধ্যা পৌনে ৮টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের গেইটে সন্দেহজনকভাবে উদ্দেশ্যহীন ঘুরাফেরা করছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন যুবক তোফাজ্জল। এদিন দুপুর কিছু শিক্ষার্থীর ফোন চুরির ঘটনায় সন্দেহপূর্বক তাকে হলের অতিথি কক্ষে নিয়ে যায় একদল শিক্ষার্থী।
সেখানে এক দফা মারধর করার পর তোফাজ্জলকে রাতের খাওয়ার খেতে দেয় শিক্ষার্থীরা।
খাওয়ানোর পর রাত পৌনে ১০টার দিকে হলের দক্ষিণ ভবনের অতিথি কক্ষে নিয়ে দ্বিতীয় দফায় ব্যাপক মারধর করা হয় তাকে। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা তাকে ছাড়াতে গেলেও শিক্ষার্থীরা তাদের কথায় কর্ণপাত করেনি বলে জানা যায়।
মারধরের এক পর্যায়ে অচেতন হয়ে গেলে কয়েকজন হাউজ টিউটর ও শিক্ষার্থীদের সহায়তায় তাকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করে।
হলের গেস্ট রুমে বর্বরোচিত নির্যাতনের ঘটনার একাধিক ভিডিও ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যেখানে বুয়েটে ছাত্রলীগের নির্যাতনে নিহত ছাত্র আবরার ফাহাদের মতোই তাকেও নির্যাতন করার দৃশ্য চোখে পড়ে। আর এই নির্যাতনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জালাল আহমেদ।
তার নেতৃত্বে অন্যরা কখনো পায়ে, কখনো হাতে, কখনো বা শরীরে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করে।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, তোফাজ্জলকে মারধরের ঘটনায় ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ভ‚মিকা রেখেছে ছাত্রলীগ নেতা জালাল আহমেদ। তাকে স্টাম্প হাতে একটি ভিডিওতে নিহত তোফাজ্জলের পাশেও দেখা যায়। জালালের সাথে দুই-তিনজন মিলে সবচেয়ে বেশি মারধর করে বলে জানা যায়। তারা হলেন-মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের ২০-২১ সেশনের মোহাম্মদ সুমন, ওয়াজিবুল ও ফিরোজ। এদের মধ্যে সুমন, ফিরোজ এবং জালাল সবচেয়ে বেশি মেরেছে বলে জানা যায়।
এদিকে এ ঘটনার নিন্দা প্রতিবাদ ও বিচার দাবিতে ক্যাম্পাস জুড়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছে গণতন্ত্রকামী শিক্ষার্থীদের ব্যানারে একদল শিক্ষার্থী।
এসময় তারা এ হত্যায় ব্যর্থতার দায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিন্দা জানান। একই দাবিতে একটি সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। এক বিবৃতিতে এ ঘটনার বিচার দাবি করে জাতীয় নাগরিক কমিটি।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে এস্টেট অফিসের সুপারভাইজার মোহাম্মদ আমানুল্লাহ শাহবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় জালাল আহমেদসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটের দিকে একজন যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের গেটে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ছাত্র তাকে আটক করে প্রথমে ফজলুল হক মুসলিম হলের মূল ভবনের গেস্টরুমে নিয়ে সে মোবাইল চুরি করেছে বলে এলোপাতাড়ি চর-থাপ্পড় ও কিলঘুষি মারে। এ সময় তাকে জিজ্ঞাসা করলে তার নাম- তোফাজ্জল বলে জানায়।
এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, পরে সে মানসিক রোগী বুঝতে পেরে তাকে ফজলুল হক মুসলিম হলের ক্যানটিনে নিয়ে খাবার খাইয়ে তাকে ফজলুল হক মুসলিম হলের দক্ষিণ ভবনে গেস্ট রুমে নিয়ে জানালার সঙ্গে পিছনে হাত বেঁধে স্ট্যাম্প, হকিস্টিক ও লাঠিদ্বারা উচ্ছৃঙ্খল কিছু ছাত্র বেধড়ক মারধর করলে সে অচেতন হয়ে পড়ে।
পরে বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন আবাসিক শিক্ষককে জানালে তাদের সহায়তায় অচেতন যুবককে মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ওই যুবককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে ডাক্তার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে ১২টা ৪৫ মিনিটের দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
অন্যদিকে বিষয়টির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।