ড. মো. কামরুজ্জামান ২৬ আগস্ট ২০২৪ , ২:৪২:১৫ অনলাইন সংস্করণ
১৫ আগস্ট ‘দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট’ বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান বিষয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম হলো: India pressed U.S. to go easy on Bangladeshi leader before her ouster, officials say.. এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রকে শেখ হাসিনার ওপর চাপ প্রয়োগ বন্ধ করতে বলেছিলো ভারত। এই সঙ্গে তার ওপর চাপ প্রয়োগ বন্ধ করার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলো ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এক বছর আগে থেকেই ভারতীয় কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের কাছে লবিং শুরু করেন। ১৫ আগস্ট মার্কিন ও ভারতীয় কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে থাকায় শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশ ইস্যুতে শিথিলতা প্রদর্শন করার জন্য চাপ দিয়েছিলো ভারত।
শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাবার পর বাংলাদেশ বিষয়ে ভারত সরকার কয়েকদফা মিটিং করেছে। উক্ত মিটিং থেকে ভারতীয় কর্মকর্তারা আমেরিকার প্রতি বাংলাদেশের ব্যাপারে বেশ কয়েকটি সতর্কবার্তা পেশ করেছে। উক্ত বার্তায় বলা হয়েছে, আমেরিকা যেনো বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পক্ষে তাদের সমর্থনকে কমিয়ে দেয়।
ওই বার্তায় আরো বলা হয়েছে, এ মুহূর্তে বিরোধী দল ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ ইসলামিস্ট জঙ্গিদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে। ফলে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ হুমকি হয়ে উঠবে। সুতরাং আমেরিকার উচিত, বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয়ে বেশি মাথা না ঘামানো।
বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত যথেষ্টভাবে সজাগ ও সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছে। সুতরাং এখানে আমেরিকার এত বেশি সমর্থন জানানো ঠিক হবে না।
বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানকে ভারত সারা দুনিয়ায় জঙ্গি হামলা বলে প্রমাণ করতে চায়। তারা দেখাতে চায়, বাংলাদেশ হিন্দুদের উপর গণহত্যা চালাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভারতীয় উপদেষ্টা দ্যা ওয়াশিংট পোস্টকে বলেন, ‘বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা আমাদের জন্য আবশ্যিক একটা বিষয়। সুতরাং তোমরা যদি আমাদের সাথে স্ট্র্যাটেজিক সম্মতিতে না আসো, তাহলে আমাদের মধ্যে কোনো স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ হবে না।’ এ ঘোষণার পর বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশ বিষয়ে সমালোচনা কমিয়ে দেয় এবং হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে স্যাংশনের হুমকি দেয়া বন্ধ করে দেয়। এতে বাংলাদেশের বিরোধীপক্ষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অবশ্য বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের সতর্ক দৃষ্টি নতুন কিছু নয়। বরং ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির সময় থেকেই তারা বাংলাদেশ বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রেখে আসছে আর এখন সেটির মাত্রা পূর্বের তুলনায় অধিক বেড়ে গেছে।
জানুয়ারির নির্বাচনের আগে মার্কিন প্রশাসনে বাংলাদেশ ইস্যুতে বিভাজন সৃষ্টি হয়। একপক্ষ চাইছিল, হাসিনার বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয়া হোক। তাদের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এবং দূতাবাসের অন্যান্য কর্মকর্তা। অন্যপক্ষ মনে করছিলেন, হাসিনাকে দূরে সরিয়ে দিলে তেমন লাভ নেই। তাছাড়া এতে মার্কিন ডিপ্লোম্যাটদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। কারণ, পিটার হাস ক্রমাগত হাসিনার অনুসারীদের কাছ থেকে থ্রেট পাচ্ছিলেন।
হোয়াইট হাউজের কিছু কর্মকর্তা চিন্তা করছিলেন, ভারতের বিরোধিতা করলে কী হতে পারে। ভারত বার বার হাসিনার ওপর থেকে চাপ কমাতে বলছিল। জয়শংকর, রাজনাথ সিং, অজিত দোভালেরা ক্রমাগতভাবে এ ধরনের প্রেসার দিয়ে আসছিলেন। ঢাকার সাবেক ডেপুটি চিফ অব মিশন জন ড্যানিলোউইজ বলেন, ‘আমেরিকা ভারতের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। তারা সাধারণত এই অঞ্চলে ভারতের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয়। এ বিষয়টি বাংলাদেশের চেয়ে বেশি প্রকটভাবে আর কোথাও দেখা যায় না। কিন্তু ঝুঁকিটা হলো, ১৯৭৯ সালের ইরানের মতো। আপনাকে যদি দেখা হয় স্বৈরাচারের সহযোগী হিসেবে, তাহলে স্বৈরাচারের পতনের পর আপনাকে তার ফল ভোগ করতে হবে। এখন নয়াদিল্লি আর ওয়াশিংটনকে নত হতে হবে, স্বীকার করতে হবে তারা বাংলাদেশের জনগণের সাথে না থেকে তাদের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষাকে প্রাধান্য না দিয়ে অন্যায় করেছে।’
সুতরাং এই মুহূর্তে দিল্লি এবং ওয়াশিংটন বাংলাদেশের কাছে ধরাশায়ী রয়েছে। কিন্তু তারা বসে নেই। তারা ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। তারা প্রতি বিপ্লবের চেষ্টা অব্যাহত রেখে চলেছে। এই প্রতি বিপ্লবের বহুবিধ পথ রয়েছে। প্রতি বিপ্লবের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ভারত বাংলাদেশে কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন হোক সেটা চাইবে না।
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য পশ্চিমা দেশকে ভারত চাপ দিচ্ছিল এই বলে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে ভারতের জন্য ভয়ানক বিপজ্জনক হবে। আমেরিকার মিত্র একটি পশ্চিমা দেশের কর্মকর্তা বলেন, ভারতের এ প্রচারণা অনেক আগে থেকেই তীব্রমাত্রায় ছিল। আর বর্তমানে ভারতের একমাত্র প্রচারণা এটাই। তারা পশ্চিমা সরকারগুলোকে বোঝাতে শুরু করে, বাংলাদেশে আওয়ামী সরকার না থাকা মানেই হলো দেশটি পরবর্তী আফগানিস্তান হওয়া। বিএনপি ক্ষমতায় এলে অস্থিতিশীলতা, সহিংসতা ও জঙ্গিবাদ শুরু হবে। বাংলাদেশ আফগানিস্তান হয়ে যাবে, এ কথাটি দেশে অনেক পুরনো প্রচারণা। আওয়ামী লীগ এবং বামধারার ব্যক্তিবর্গ এ প্রচারণা বিগত কয়েক যুগ ধরে করে আসছেন। আর এটা পুরোপুরি ভারতীয় প্রোপাগান্ডার অংশ। এ প্রোপাগান্ডা প্রতিষ্ঠা করতে ভারত এমন কিছু নাই, যা করেনি।
একজন সাবেক ভারতীয় জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা থেকে যেই আসছিল, সবার মুখে একটা কথাই ছিল যে, বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব অভাবনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম চরমভাবে ভারত বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করে। কিন্তু তথাপিও আমরা হিসাব করেছিলাম, দেশের প্রশাসন ও রাষ্ট্রশক্তির ওপর হাসিনার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। আমরা ভেবেছি, সরকারকে দুর্বল করার প্রচেষ্টা আগে যেমন ব্যর্থ হয়েছে, এবারও তেমন ব্যর্থ হবে এবং হাসিনা সব কিছু ম্যানেজ করে নেবে। কিন্তু সত্যি কথা হলো, একটামাত্র আগুনের ফুলকিই পুরো ঘরে আগুন লাগাতে যথেষ্ট ছিল এবং তাই লাগলো।
ভারত এবারও নিশ্চিত ছিল যে, হাসিনা থাকছে। কারণ, প্রশাসনের সকল সেক্টরেই হাসিনার একক নিয়ন্ত্রণ ছিল। হাসিনা ভেবেছিলেন, আর্মি থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত তার নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া ভারতের মতো শক্তিশালী খুঁটিতো তার পাশেই আছে। আর এ কারণেই হাসিনা ডেস্পারেটলি ভয়ংকররূপে রক্ত ঝরাচ্ছিলেন। তার সরকার এবং তিনি নিজে টিকে যাওয়ার ব্যাপারে ভীষণ কনফিডেন্ট ছিলেন। ভেবেছিলেন, কেউই তাকে টলাতে পারবে না। আর হাসিনা যদি এবার টিকে যেতেন, ভারত ঠিকই সারা বিশ্বে এ কথা বলে চালিয়ে দিতো যে, হাসিনা অনেক ভালো শাসক!
তাই, এ মুহূর্তে দেশবাসী ও আন্দোলনকারীদের উচিত প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কাকে তুচ্ছ না ভাবা! এ জাতীয় আলাপ-আলোচনাকে উড়িয়ে দেয়া ঠিক না। ভারত কোনোভাবেই চায় না এদেশে হাসিনা সরকার দীর্ঘসময়ের জন্য ক্ষমতার বাইরে থাকুক। একই সাথে সে চায় না, এদেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতবিরোধী কোনো শক্তি ক্ষমতায় আসুক। ভারত সব সময় অস্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায়, এর স্থিতি চায় না।
বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইলে এই মুহূর্তে করা সম্ভব নয়। কারণ, আপ টু বটম চেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সুতরাং, যা করতে হবে, বুঝে শুনেই করতে হবে। এদেশে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী সরকারের বুদ্ধিজীবীরা যা করতে পারে তা হলো:
প্রথমত, তারা জুডিসিয়াল ক্যু করার চেষ্টা করেছিল। সেখানে তারা ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে ফেল করেছে। চিফ জাস্টিস থেকে শুরু করে পুরো জুডিসিয়াল সেক্টর এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। সুতরাং এখানে খুব সম্ভবত ব্যাক করবে না তারা।
এরপরে আসে, মিলিটারি ক্যু। অনেকেই বলেছে, ওয়াকার উজ জামান খুব ভালো মানুষ। তিনি ঠান্ডা মাথার মানুষ। তার মাধ্যমে ক্যু করার চেষ্টা আগে যেমন সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয় না। তারপরও পরের কথা আগে বলা যায় না।
তৃতীয়ত, ইন্টিলিজেন্স এজেন্সি। আমরা জানি, ‘র’ ডিজিএফআই ও এনএসআই এর মাধ্যমে বাংলাদেশে তাদের পলিসি ইমপ্লিমেন্ট করতো। কিন্তু এই মুহূর্তে ডিজিএফআই ও এনএসআই-এর ডাইরেক্টর জেনারেল চেঞ্জ হয়েছে। এ পদ দুটিতে নতুনভাবে পদায়ন হয়েছে। তবে এই চেইন অব কমান্ডের পরিবর্তন আসলে কতটা ফলপ্রসূ হতে পারে সেটা দেখার বিষয়। মনে রাখা দরকার, যারা ফিল্ডে পলিসি বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেন তারা হাই ট্রেইন্ড এবং স্কিল্ড। তারচেয়ে বড় কথা, ফিল্ড অপারেটিভ চাইলেই চেইন অব কমান্ডকে ডিনাই করতে পারে।
চতুর্থত, স্যাবটাজ। সচিবালয়, বঙ্গভবনসহ দেশের বিভিন্ন ক্রিটিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার যদি স্যাবটাজের শিকার হয়, সেক্ষেত্রে দেশকে অস্থিতিশীল করা খুব সহজ। ভবিষ্যতে যেকোনো উপায়ে মরণ কামড় দিতে পারে।
এখন আমেরিকা কাকে বেশি প্রাধান্য দেয় সেটাই দেখার পালা। তার ইনার সার্কেলের ড. মুহাম্মদ ইউনূস, নাকি সাবেক চা বিক্রেতা মোদি? দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা দেখে আর ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন পড়ে আমার একটাই উপলব্ধি হয়েছে, হাসিনা ছেড়ে দিতে চাইলেও ভারত সহজে ছেড়ে দেবে না।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
dr.knzaman@gmail.com