ভাটি বাংলা ডেস্কঃ ২১ আগস্ট ২০২৪ , ৩:৪২:১৯ অনলাইন সংস্করণ
সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি শাহ মিজান মো. শাফিউর রহমান (বিপিএম-বার, পিপিএম-সেবা) ও সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার (এসএমপি) মো. জাকির হোসেন খানকে (পিপিএম-সেবা) প্রত্যাহার করে বাহিনীটির দুটি ইউনিটে সংযুক্ত করা হয়েছে।
বুধবার (২১ আগস্ট) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে তাদের প্রত্যাহার করা হয়। তাদের স্থলে কারা আসছেন তা এখনো জানা যায়নি।
এরই মধ্যে বিএনপির মিছিলে পুলিশ, আ’লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের সশস্ত্র ঘটনায় এসএমপি কমিশনার মেয়র মো. জাকির হোসেন খানকে এক নং আসামী করে ৫৯ জনের বিরুদ্ধ সিলেটের একটি আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই মামলায় আসামীর তালিকায় রয়েছেন সাবেক মেয়র, সাবেক ৩ এমপি সহ ৫৯ জন।
পুলিশের এই দুই উর্ধ্বতন কর্মকর্তার আমলে সিলেটের পুলিশের তৎপরতা নিয়ে গণ অসন্তোষ চরমে ছিল। গোটা সিলেট ও এসএমপির এলাকা জুড়ে ভারতীয় চিনির অবৈধ চালানের ঢল নেমেছিল। সেই কারবার থেকে মোটা অংকের বখরা পেতেন পুলিশের এই দুই শীর্ষ কর্মকর্তা। ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামীলীগের স্থানীয় কতিপয় চিহ্নিত নেতাদের চোরাকারবারী ব্যবসার সহযোগী ছিলেন তারা। দিন দুপুরে প্রকাশ্যে ট্রাক ভর্তি চিনির চালান সিলেট হয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেত, পুলিশের চোখের সামনে। মনে হতো সিলেট-ভারত সীমান্ত বলতে কিছু নেই, ওপেন অবৈধ এ কারবারে দেশীয় চিনির বারোটা বাজে, সেই সাথে পুলিশের দায়িত্ব কর্তব্য বলতে কিছু আছে বলে মনে হয়নি।
অর্থাৎ অবৈধ ও বৈআইনী কাজের পৃষ্টপোষকে পরিনত হয় সিলেট রেঞ্জ ও এসএমপি পুলিশ। এতে সাধারন মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা হারায় পুলিশ বাহীনি। এ নিয়ে গণমাধ্যেমে সংবাদ প্রকাশ হলেও তাতে পাত্তাই দেননি তারা। বরং পুলিশের বাগবাটোয়ারার অংশ বেড়ে যায়। এছাড়া আই ওয়াসের জন্য মাঝে মধ্যে চিনির চালান ধরা পড়লে, বিধি মেতাবেক নিলামের পরিবর্তে তাতেও সরকার দলীয়দের সিন্ডিকেটে বিক্রি করা হতো, এমনকি অনেক থানার চিনি বা পেয়াজ বা অবৈধ সামগ্রি নিলামের পরিবর্তে অতিগোপনে বিক্রি করে দিতে থানা সংশ্লিষ্ট পুলিশ।
এ নিয়ে কোন জবাবদিহিতা মোটেই ছিল না। এরকম অবস্থায় কোটা সংস্কার আন্দোলন দমন নিপীড়নে নামে পুলিশ। তাদের মারমুখি এ্যাকশনে সাংবাদিক তুরবা নিহত হন, সেই সাথে আহতদের তালিকা বেহিসাব। আন্দোলনকারীদের বাসা ভাড়ি শুধু নয়, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ঘরবাড়ি তল্লাশি, অভিযান সহ তাদের ভাই বোন স্ত্রীকে হেনেস্তা করার অভিযোগের শেষ নেই, সেই সাথে মামলাবাজীতে ছিলেন তারা অতি উৎসাহী। এই দুই নেতা মুলত চলতেন সাবেক মেয়র ও শেখ রেহানার ঘনিষ্টজন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর মর্জিতে। আর আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর অনুগতরা ভারতীয় চিনি সহ সেই লাইনে নিজেদের লােক বসিয়ে সিন্ডিকেট করে রেখেছিল পুলিশে।
অপরদিকে, প্রত্যাহারকৃত সিলেট রেঞ্চ ডিআইজি নিয়ে শাহ মিজান শাফিউর রহমান অনু বাংলাদেশ পুলিশের ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে যারা গুম, খুনসহ নানা অপকর্মে জড়িত ছিলেন শাহ মিজান তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি যেখানেই দায়িত্বে ছিলেন সেখানেই সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ছিলেন প্রাণ হারানোর হুমকিতে। যে কারণে তার পরিচিতি গড়ে উঠে ‘জল্লাদ’ শাহ মিজান নামে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে ঘটে অসংখ্য বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার জানিয়েছে, ২০১৪ সালে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয় ১৭২ জনকে এবং ২০১৫ সালে ১৭৮ জনকে। ওই সময়ে যে কয়েক জেলায় সবচেয়ে বেশি বন্দুকযুদ্ধ বা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে তারমধ্যে অন্যতম লক্ষ্মীপুর জেলা।
ওই সময়ে লক্ষ্মীপুর জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ছিলেন শাহ মিজান শাফিউর রহমান। একইভাবে তিনি চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ যখন যেখানে ছিলেন, তখন সেখানে সবচেয়ে বেশি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সফল অফিসার। যে কারণে তাকে বিপিএম, পিপিএম পদক দিয়ে সম্মানীত করা হয়েছে। পুলিশ বিভাগে যখন যা চেয়েছেন তাই পেয়েছেন শাহ মিজান শাফিউর রহমান। ২০০১ সালে পুলিশে যোগ দেন তিনি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভাগ্য পরিবর্তন ঘটতে থাকে তার। ২০১৪ সাল থেকে দ্রুত তার উন্নতি ঘটে। শাহ মিজান শাফিউর রহমান যখন লক্ষ্মীপুরের এসপি, তখন ওই এলাকার বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা কখনো রাতে বাসায় ঘুমাতে পারতেন না। পুলিশ ও ডিবি হন্যে হয়ে নেতাকর্মীদের খুঁজে বেড়াত। ডিবি পুলিশের একটি টিম ছিল শাহ মিজান শাফিউর রহমানের পছন্দের কয়েক কর্মকর্তার সমন্বয়ে গড়া। ওই টিমটি বেশির ভাগ কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’র ঘটনা ঘটিয়েছে।
#
২০১৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মান্দারি মটোবিতে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হয় মো: ইউনুছকে। ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যদের সাথে বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হন মো: নজরুল ইসলাম (২৬) নামে যুবদলের এক নেতা। রাত ১টার দিকে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পালেরহাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নজরুল ইসলাম উপজেলার দক্ষিণ হামছাদি ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি। যুবদল নেতা নজরুল অভিযোগ করেন, বন্দুকযুদ্ধ বলতে কিছু ঘটেনি। তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গুলি করা হয়। তিনি জানান, এসপির নির্দেশে লক্ষ্মীপুরের তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (সদর) জুনায়েত কাউসারসহ কিছু পুলিশ সদস্য এই অভিযানে সম্পৃক্ত ছিলেন।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের লতিফপুর গ্রামে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যু ঘটে ২৪ বছর বয়সী যুবদল কর্মী রনির। রনির পরিবারের অভিযোগ, গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায়। পরে গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে। রনি চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের দেওপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা (পূর্ব) যুবদলের সদস্য ছিলেন।
২০১৪ সালের ২৩ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের তৎকালীন সদর থানার উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি শামসুল ইসলাম সোলায়মানকে ঢাকার উত্তরা থেকে তুলে নেয়া হয়। পরবর্তীতে ২৬ এপ্রিল তার লাশ পাওয়া যায় লক্ষ্মীপুরের চরশাহী ইউনিয়নের রামপুরা থেকে তার গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। তার শরীরে ১৮টি গুলির চিহ্ন ছিল। সারা শরীর থেঁতলানো ছিল তার। তখনকার র্যাবের তারেক সাঈদ ওই পরিবারের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকাও নিয়েছিল। রাতে এই টাকা নেয়। আর পরিবার ভোরে লাশ পায়।
২০১৬ সালের ৫ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরে পুলিশের সাথে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন কাউছার আহমেদ (৩০)। লহ্মীপুর সদরের চন্দ্রগঞ্জ তিন নম্বর ব্রিজের কাছে তার লাশ পাওয়া যায়। নিহত কাউছার লক্ষ্মীপুর সদরের পশ্চিম লক্ষ্মীপুর গ্রামের ইউনুস মিয়ার পুত্র। এভাবেই একের পর এক লহ্মীপুরে ঘটতে থাকে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা। আর ভাগ্য খুলতে থাকে শাহ মিজান শাফিউর রহমানের।
২০১৬ সালের শেষে দিকে তিনি যোগ দেন ঢাকা জেলায়। ওই সময়ে ঢাকা জেলার বিএনপি, জামায়াতের নেতাকর্মীরা ছিলেন চরম হুমকিতে। গায়েবি মামলা থেকে শুরু করে এমন কোনো নির্যাতন নেই যা করা হয়নি তাদের। এমনকি বাদ যাননি সাংবাদিকরাও। পোশাক শ্রমিকদের উসকানি ও প্যান্ট চুরিসহ পাঁচটি মামলায় গ্রেফতার করা হয় সাভারের সাংবাদিক নাজমুল হুদাকে।
তাকে ২০১৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর রাতে সাভার থেকে টেলিফোনে আশুলিয়ায় ডেকে নিয়ে আটক করে পুলিশ। পরের দিন তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করা হয়। মূলত শাহ মিজানের অপকর্ম নিয়ে কয়েকটি সংবাদ প্রকাশের পর ক্ষুব্ধ হয়ে সাংবাদিক নাজমুল হুদাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৭ সালের কেরানীগঞ্জের মিরেরবাগে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয় আমীর নামে এক যুবককে।
রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগ থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন শাহ মিজান। ওই সময়ে ছাত্রলীগের একটি হলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। তার স্ত্রীও ছাত্রলীগের কর্মী। তিনি বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার, দায়িত্ব পালন করছেন ইডেন কলেজে। শাহ মিজান শাফিউর রহমান, প্রথমে চট্টগ্রাম, পরে ডিএমপিতে যোগ দিয়ে দলীয় ক্যাডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। পরবর্তীতে পুরস্কারস্বরূপ তাকে লক্ষ্মীপুরের এসপি হিসেবে পদায়ন করা হয়। লক্ষ্মীপুরে তার সময়ে বিএনপি-জামায়াতের অন্তত ১১ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ঢাকা জেলায় পুলিশ সুপার থাকাকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে। ওই সময়ে সালমান এফ রহমানের সহযোগিতায় ‘হাফিজ-নাজনীন ফাউন্ডেশন’ গড়ে তোলেন শাহ মিজান শাফিউর রহমান। ওই ফাউন্ডেশন থেকে ২০২১ সালে ঢাকার কেরানীগঞ্জের কলাতিয়ায় প্রতিষ্ঠান করেছেন প্রিয়বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ। সূত্র মতে, ঘুষ-দুর্নীতির টাকা ওই ফাউন্ডেশন ও স্কুলের নামে নেন তিনি। সালমান এফ রহমান তাকে দিয়ে ঢাকা জেলার বিএনপি-জামাতের নেতাকর্মীদের দমন করতে থাকেন। পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে ডিএমপিতে যুগ্ম কমিশনার হিসেবে যোগদান করেন শাহ মিজান। শাহ মিজান শাফিউর রহমান ছিলেন সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারি গ্রুপের সক্রিয় অফিসার। ওই সময়ে ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলামের একটি চিঠি পুলিশ সদর দফতরে পাঠালে তা ফাঁস হয়ে যায়। ওই চিঠির সূত্র ধরে তৎকালীন পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ তাকে রংপুরে বদলি করেন। পরবর্তীতে ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ঢাকায় সিটিটিসিতে যোগদান করেন। ওই সময়ে যে কোনো একটি রেঞ্জের দায়িত্বের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন শাহ মিজান।
পরবর্তীতে সালমান এফ রহমানের আনুকূল্য থাকায় তাকে সিলেটের ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও তার নির্দেশে ছাত্র, সাংবাদিকসহ অনেককে হত্যা করা হয়েছে। আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই থেকে সিলেটে নিহত হয়েছেন ২১ জন।
এর মধ্যে ১৯ জনই নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে। শত শত কোটি টাকার মালিক শাহ মিজান শাফিউর রহমান সম্পর্কে তার ঘনিষ্ঠরা জানান, তিনি অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির। অবৈধভাবে বিপুল অর্থের মালিক হলেও ঘুষ-দুর্নীতির কোনো প্রমাণ রাখেন না তিনি। অর্থ লেনদেন করেন নিজে। সিলেট রেঞ্জের যেসব থানা থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের অর্থ আসে, সেসব থানার ওসিরা তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ওসিরা টাকা নিয়ে ছুটে যান তার বাসায়। সেখানে ‘ওয়ান টু ওয়ান’ লেনদেন হয়। নিজের ঘনিষ্ঠ ছাড়া অন্যদের কাছ থেকে টাকা নিতেন না তিনি।
Notifications