রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। রোববার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাকী-আল ফারাবী মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)কে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এর আগে একই আদালতে এ মামলার আবেদন করেন বাংলাদেশ পিপলস পার্টির (বিপিপি) চেয়ারম্যান বাবুল সরদার চাখারী।
আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে অভিযোগের বিষয়ে মতিঝিল থানা পুলিশকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। এ ছাড়া, আন্দোলনে শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যা করায় তার বিরুদ্ধে শনিবার মধ্যরাতে লালবাগ থানায় একটি ও গতকাল রোববার সূত্রাপুর থানায় মামলা হয়েছে। এ নিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকায় নয়টি মামলা হলো। হত্যার অভিযোগে ৮টি এবং অপরটি গুম ও অপহরণের অভিযোগে।
হেফাজতের সমাবেশে গণহত্যার মামলা: মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাকী-আল ফারাবীর আদালতে এ মামলা করেন বাংলাদেশ পিপলস পার্টির (বিপিপি) চেয়ারম্যান বাবুল সরদার চাখারী। এর আগে আদালতে মামলার আবেদন করেন এই রাজনীতিবিদ। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে মতিঝিল থানার ওসিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেন।
মামলার আবেদনে আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৪৭/৩৬৫/৩৬৬/ ৩০৭/ ৩২৬/ ৩০২/ ৩৪ ধারার অভিযোগ আনা হয়েছে।
২০১৩ সালের ৫ই মে মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যার অভিযোগে করা মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামরিক উপদেষ্টা তারেক সিদ্দিকী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস, সাবেক এমপি রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবুল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, হাসান মাহাবুব খন্দকার, র্যাবের সাবেক প্রধান এ কে এম শহিদুল হক, এনএসআই’র সাবেক প্রধান জিয়াউল হাসান, মতিঝিল বিভাগের সাবেক ডিসি বিপ্লব কুমার সরকার, মতিঝিল থানার সাবেক ওসি ওমর ফারুক, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মুনসুর আহমেদ, তৎকালীন মতিঝিল থানার ছাত্রলীগ সভাপতি মাহাবুবুল হক হিরন, ইমরান, আওয়ামী লীগ নেত্রী মমতাজ পারভীন, মতিঝিল থানার সাবেক ওসি ফরমান আলী, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন সালু, মতিঝিলের সাবেক ডিসি নাজমুল আলম, হামদর্দ গ্রুপের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক মেজর ইকবাল ও আশরাফুজ্জামান।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় ব্লগাররা ধর্মীয় অবমাননা ও হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কটূক্তি এবং বাজে লেখালেখি করার প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফা দাবি করে।
সরকার দাবি না মানায় ২০১৩ সালে ৫ই মে মতিঝিল শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয় হেফাজতের নেতাকর্মীরা। ওইদিন রাত ১১টা থেকে পরের দিন বেলা ১১টা পর্যন্ত রাস্তা ও বিদ্যুৎ লাইন বন্ধ করে শেখ হাসিনার মদতে আসামিদের যোগসাজশে অন্য আসামিরা পুলিশ ও আর্মি সদস্যরা মিলে নিরীহ মাদ্রাসাছাত্র ও পথচারীদের ওপর গণহত্যা চালায়। তাদের হত্যা করে লাশ সিটি করপোরেশনের গাড়িতে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে গুম করে। এজাহারে আরও বলা হয়, এসময় বহু মাদ্রাসাছাত্র হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাদের অভিভাবকরা সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা ও জিডি করতে গেলে থানা কর্তৃপক্ষ কোনো মামলা নেয়নি। তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার মানুষকে নির্বিচারে গণহত্যার কারণে আদালতে মামলাটি এনেছেন এই রাজনৈতিক।#
সূত্রাপুর থানায় দুই শিক্ষার্থী হত্যা মামলা:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজধানীর সূত্রাপুরে দুই শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। নিহত শিক্ষার্থীরা হলেন- কবি নজরুল সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ইকরাম হোসেন কাউসার ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের ওমর ফারুক। গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তরিকুল ইসলামের আদালতে এ মামলা করেন নাসরিন বেগম নামে এক নারী। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে সূত্রাপুর থানাকে মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক ডাক-টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আব্দুল্লাহ আল মামুন, ডিএমপি’র সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, ডিএমপি’র সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ, ডিএমপি’র সাবেক অতিরিক্ত যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সহ অজ্ঞাতনামা আরও ২০০ থেকে ২৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ১৯শে জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা সূত্রাপুর থানাধীন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের সামনে অবস্থান নেয়। তাদের সঙ্গে পুলিশ, আওয়ামী লীগ সহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিও চালানো হয়। এতে কবি নজরুল সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ইকরাম হোসেন কাউসার ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের ওমর ফারুক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।
লালবাগ থানায় শিক্ষার্থী হত্যা মামলা:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর লালবাগে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী খালিদ সাইফুল্লাহকে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৯১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। শনিবার মধ্যরাতে রাজধানীর লালবাগ থানায় এ মামলা দায়ের করেন নিহত সাইফুল্লাহর বাবা। মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তথ্য প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সহ ৯১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অন্য শিক্ষার্থীদের মতো আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী খালিদ সাইফুল্লাহও অংশ নেয়। গত ১৮ই জুলাই আসামিদের প্রত্যক্ষ মদতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শিক্ষার্থীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান খালিদ। এরপর তার লাশ ২০শে জুলাই হাসপাতালে শনাক্ত করা হয়।
এ মামলার বাদী খালিদ সাইফুল্লাহ’র পিতা কামরুল হাসান অভিযোগ করে বলেন, মামলা নিয়ে শুরু থেকেই গড়িমসি করেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দেয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে। প্রায় দেড় শতাধিক এলাকাবাসী থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন। শনিবার রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ জনতা থানায় অবস্থান করছিলেন। এ বিষয়ে লালবাগ থানার ওসি খন্দকার হেলাল উদ্দিন বলেন, নিহতের পরিবার রাতে থানায় মামলা করতে আসে।
হত্যা মামলা হওয়ায় তাদের বলেছি, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে মামলা রুজু করতে হবে। এজন্য তাদের রোববার সকালে আসতে বলা হয়। এতে তারা রাজি হননি। লোকজন এসে মামলা নিতে চাপ দিতে থাকে। পরে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে রাত ২টার দিকে মামলার এজাহার গ্রহণ করা হয়।