• সারাদেশ

    রক্তের বন্যা বইয়ে গোপনে দেশ ছেড়ে পালালেন হাসিনা

      নিউজ ডেস্কঃ ৬ আগস্ট ২০২৪ , ৩:০০:৪৪ অনলাইন সংস্করণ

    শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে প্রবেশ করে ছাত্র-জনতার উল্লাস : নয়া দিগন্ত 


    বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা দাবির মুখে পদত্যাগ করে গোপনে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে বঙ্গভবন থেকে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে চড়ে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়েন। তার সাথে ছোট বোন শেখ রেহানাও রয়েছেন। হেলিকপ্টারটি ভারতের উদ্দেশে ছেড়ে যায় বলে জানা গেছে। তবে শেখ হাসিনার শেষ গন্তব্য কোথায় তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এর আগে শেখ হাসিনাকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ৪৫ মিনিট সময় বেঁধে দেয়া হয়। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের সময় কারফিউ ভেঙে গণভবনের পাশে লাখ লাখ ছাত্র-জনতা অপেক্ষা করছিল ভেতরে প্রবেশের জন্য। চূড়ান্ত খবর জানার পর দলে দলে মানুষ গণভবনের ভেতরে ঢুকে পড়েন।

     


    একচ্ছত্র প্রতাপশালী এই নেত্রীর পলায়নের বিষয়ে অনেকেই বলছেন, তিনি মূলত আওয়ামী লীগকেই ধ্বংস করে দিয়ে গেলেন। কেউ কেউ বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা সবচেয়ে লজ্জাজনক বিদায়। স্বৈরাচার এরশাদেরও এমন লজ্জাজনক বিদায় হয়নি বলে অনেকে মন্তব্য করেন।


    আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন এ বছরের ১১ জানুয়ারি। এর আগে ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদে নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। পরবর্তীতে ২০০৮ এর নির্বাচন থেকে তার ক্ষমতায় আসার প্রতিটি অধ্যায়ই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

    একটি নির্বাচন ছিল বিনা ভোটের, একটি ছিল রাতের ভোটের এবং সর্বশেষ এবারের নির্বাচন ছিল নিজ দলেরই ডামি প্রার্থী দিয়ে। জনগণের রায় প্রতিবারই তিনি উপেক্ষা করে ক্ষমতায় এসেছেন। জনগণ তার এই ক্ষমতা গ্রহণের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিলেন। কিন্তু জোরালো প্রতিবাদ করার ক্ষমতা কারোরই ছিল না। যারা রাস্তায় নেমেছেন তারাই দমনপীড়নের শিকার হয়েছেন বছরের পর বছর। জেল-জুলুম-অত্যাচারের শিকার হয়েছেন।

     

    হত্যা-গুমের শিকার হয়েছেন। শেখ হাসিনা তার পেটোয়া বাহিনী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুগত সদস্যদের দিয়ে প্রতিবাদীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করে গেছেন। মানুষের বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এমনকি গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন উলঙ্গভাবে।

    সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় বসে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। এরপর ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন হয় একতরফা, যেখানে বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। এই নির্বাচন আগের রাতেই ব্যালটে সিল মারার ব্যাপক অভিযোগ ছিল। এ নির্বাচন ‘রাতের ভোট’ নামে পরিচিতি পায়। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আবার প্রধানমন্ত্রী হন। তবে এ নির্বাচনও বিতর্কিত। এতেও প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। নিজদলীয় নেতাদের স্বতন্ত্রপ্রার্থী করে ‘ডামি’ প্রতিদ্বন্দ্বিতার আয়োজন করা হয়। এ নির্বাচনটিকে বিরোধীরা ‘ডামি নির্বাচন’ বলে আখ্যা দেন। ছয় মাসের মাথায় ব্যাপক ছাত্র ও গণবিক্ষোভের মুখে তিনি গতকাল পদত্যাগ করে লজ্জাজনকভাবে হেলিকপ্টারযোগে দেশ থেকে পলায়ন করেন।

    ব্যাপক রক্তক্ষরণের পর গত রোববার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ঘোষণা দেন সোমবার মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির। এই কর্মসূচি ঠেকাতে রাত থেকেই রাজধানীর প্রবেশদ্বারগুলোয় রাত থেকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এই পুলিশ সদস্যরা ছিল সরকারের একান্ত অনুগত। তারা দায়িত্ব নিয়েছিল যাতে বাইরে থেকে একজন ছাত্র-জনতাও ঢাকায় প্রবেশ করতে না পারে।
    এ দিকে ফজর হওয়ার আগেই রাজধানীর প্রবেশপথগুলো হাজার হাজার ছাত্র-জনতা জড়ো হয়ে যায় রাজধানীতে প্রবেশের জন্য। তাদের ওপর ভোরে বিভিন্ন স্থানে গুলি চালানো হয়। এ দিকে সময় যত গড়াতে থাকে ছাত্র-জনতার ঢল তত বাড়তে থাকে। তাদের টার্গেট একটাই গণভবন। তারা গণভবনে যাবেন এবং শেখ হাসিনাকে উচ্ছেদ করবেন।

    এ দিকে ছাত্র-জনতার এই রোষ বুঝতে পেরে বেলা ১১টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি দল শেখ হাসিনার সাথে দেখা করেন। তারা ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তাকে দেশত্যাগের অনুরোধ করেন। কিন্তু শেখ হাসিনা এতে কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিলেন না। একটি সূত্র জানায়, কিন্তু একপর্যায়ে তিনি দেশত্যাগে রাজি হন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পাসপোর্ট নিয়ে তিনি দেশত্যাগ করতে চান। প্রধানমন্ত্রীর পাসপোর্ট নিয়ে তিনি কোন দেশে গেলে সেই দেশ তাকে গ্রহণ করতে বাধ্য। শেখ হাসিনা এই সুযোগটি নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে রাজি হয়নি সেনাবাহিনী।

     


    ওই সূত্রটি জানায়, একপর্যায়ে শেখ হাসিনা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর তিনি অনুরোধ করেন অন্তত জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ দিয়ে তিনি দেশ ছাড়তে চান। তখন সেনা সদস্যরা বলেন, ওই সময় নেই। সেনা সদস্যরা তাকে ৪৫ মিনিট সময় বেঁধে দেন।


     

    ওই সময়ের মধ্যে তিনি রেডি হতে না পারলে জনরোষ থেকে বাঁচবেন না এটাও জানিয়ে দেয়া হয়। সূত্র জানায়, এই সময় পুরো দেশের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। এরপর তিনি তেজগাঁওয়ে রাখা হেলিকপ্টারের উদ্দেশে গণভবন থেকে বের হন। গণভবন থেকে তেজগাঁওয়ের ওই স্থানটি পর্যন্ত একটি সুরঙ্গ আছে বলে জানা যায়। ওই সুরঙ্গপথ দিয়েই তাকে হেলিকপ্টার পর্যন্ত নেয়া হয়। তিনি হেলিকপ্টারে ওঠার পরই গণভবন ছাত্র-জনতার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। একই সাথে ইন্টারনেট সংযোগও চালু করে দেয়া হয়।

    জানা গেছে, শেখ হাসিনার প্রথম গন্তব্য ছিল ভারতের আগরতলা। আগরতলায় যাওয়ার পর সেখানের সাধারণ মানুষ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। যে কারণে তিনি আগরতলায়ও থাকতে পারেননি। পরে ভারতের গণমাধ্যম খবর দিয়েছে, সেখান থেকে শেখ হাসিনাকে বহনকারী একটি কার্গো বিমান নয়াদিল্লির উপকণ্ঠে উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদের কাছে হিন্দন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করে। সেখান থেকে কোথায় যেতে পারেন তা জানা যায়নি। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, তিনি যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন, তবে কোনো সবুজ সঙ্কেত পাননি।

    এ দিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক এম সাখাওয়াত হোসেন গতকাল গণমাধ্যমকে বলেছেন, দেশে আজকে যা ঘটল, এটাই হওয়ার কথা ছিল। গণ-অভ্যুত্থান কখনো ঠেকানো যায় না। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন সহজেই সমাধান করা যেত। কিন্তু শেখ হাসিনার জেদের কারণে এত মানুষ মারা গেল। তিনি বলেন, গণমাধ্যমে প্রাণহানির যে চিত্র উঠে এসেছে, বাস্তবে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি। আরো কত লাশ কোথায় পড়ে আছে, কত গণকবর হয়েছে, কতগুলো নিরীহ মানুষের প্রাণ ঝরেছে তার কোনো হিসাব নেই। তিনি তো চলে গেলেন। প্রশ্ন হলো,এখন এর জবাব দেবে কে?

    তিনি বলেন, ১৫ বছর মানুষ ভোট দিতে পারেননি। দিনের পর দিন ভোট চুরি করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। শেখ হাসিনার বোঝা উচিত ছিল, তিনি ও তার দল কতটা অজনপ্রিয়। এই যে এত প্রাণহানি, এর জবাব দেবে কে? দেশে সুশাসনের মারাত্মক অভাব। তিনি সুশাসন দিতে পারেননি। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের ওপর হাজার হাজার গুলি ছোড়া হয়েছে। হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে। এর আগে আমরা সবাই এইচ এম এরশাদকে স্বৈরাচার বলেছি। তখন মাত্র ছয়জন মানুষ মারা যাওয়ায় তাকে স্বৈরশাসক বলছি। কিন্তু গত ১৫ বছরে কত মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। ২০০৯ সালে পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা মারা গেছেন। এখন এর জবাব দেবে কে?

    বিগ্রেডিয়ার (অব:) সাখাওয়াত হোসেন উল্লেখ করেন, শ্রীলঙ্কা থেকে হাসিনার সরকার শিক্ষা নেয়নি। তিউনিসিয়া থেকে শিক্ষা নেয়নি। মিসরে কিভাবে হোসনি মোবারক জনরোষে উড়ে গেছে, সেখান থেকে সরকার শিক্ষা নেয়নি। জনগণের সরকার না হলে এমন পরিণতি হয়। এরশাদের চেয়ে শেখ হাসিনা ১০০ গুণ বেশি খারাপ হয়ে বিদায় নিয়েছেন। এরশাদ পালিয়ে যাননি। তিনি পালিয়ে গেছেন। তিনি পালিয়ে গেছেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ দলটাকে ধ্বংস করে দিয়ে গেলেন। তার হিংসা, দম্ভ, অহঙ্কার দলটাকে ধ্বংস করল।

    আরও খবর

    Sponsered content