• অর্থনীতি

    বিদেশে পাচারের টাকা ফেরতের উদ্যোগ

      ভাটি বাংলা ডেস্ক: ৩১ আগস্ট ২০২৪ , ২:১১:৩৩ অনলাইন সংস্করণ

    এস আলম, সামিট, বসুন্ধরা, ওরিয়ন, নাসাসহ কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রæপের টাকা পাচারের তথ্য চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশে পাঠানো হয়েছে চিঠি.

     

    শেখ হাসিনা রেজিমে ১৫ বছর দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। কানাডার টরেন্টোতে বেগম পাড়া গড়ে উঠেছে। বিদেশির জন্য মালয়েশিয়ান সরকারের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ। টাকা পাচার করে লন্ডন ও দুবাইকে শত শত বাড়ি, ফ্লাট নির্মাণ হয়েছে। এছাড়াও হংকং, দুবাই, সিঙ্গাপুরে অনেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর অফিস রয়েছে।

     

    সেখানে তারা পুঁজি পাচার করে নিয়মিত ব্যবসা করছেন। একই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন পদে থাকা বড় কর্মকর্তাদের বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের তথ্য ইতোমধ্যে বেরিয়ে এসেছে।

     

    এছাড়া রাষ্ট্রীয় মদদে বিভিন্ন বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠীর অর্থ পাচারের তথ্য ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। আর তাই দেশে-বিদেশে প্রভাবশালীদের অবৈধ সম্পদের খোঁজে জোর তৎপরতা শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।



    প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার সাথে কথা বলে আশাবাদী হয়েছেন পাচারকৃত অর্থ অধিকাংশই ফেরত আনা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে পাচারের অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে ক‚টনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের অর্থ আত্মসাতকারীদের স্থানীয় সম্পদ অধিগ্রহণ এবং বিদেশে পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধার করা হবে।



    গত ১৫ বছরে অর্থ পাচারে প্রাথমিকভাবে যাদের নাম উঠে আসছে তাদের মধ্যে অন্যতম আর্থিকখাতের বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রæপ, সামিট, বসুন্ধরা, ওরিয়ন, নাসা, থার্মেক্স গ্রæপসহ বিভিন্ন গ্রæপের নাম রয়েছে। ইতোমধ্যে এসব গ্রæপের অনেকের কাছে তথ্য চেয়ে একাধিক দেশে চিঠি দিয়েছে আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট।

    একই সঙ্গে অর্থ পাচার করা হয়েছে যেসব দেশে যেমন- সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত (দুবাই), সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সুনির্দিষ্ট তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইউ) থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। অর্থ পাচার নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার মতে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৫৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। তবে বাস্তবে আরও বেশি অর্থ পাচার হয়েছে।

    যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গেøাবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে শুধুমাত্র ২০১৫ সালের চিত্র তুলে ধরে বলেছে, বাংলাদেশ থেকে চার প্রক্রিয়ায় ৫৯০ কোটি ডলার (দেশীয় মুদ্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা) পাচার হয়েছে। এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি ওয়াশিংটন থেকে জিএফআই’র এ রিপোর্ট প্রকাশ হয়। জিএফআই’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪টি প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ থেকে এই অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রফতানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডি ও অন্য মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন এবং ভিওআইপি ব্যবসা।

    জিএফআই’র তথ্যমতে, ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা ওই সময়ে দেশের ২০১৮-২০১৯ জাতীয় বাজেটের চেয়েও বেশি ছিল। প্রতিবছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। এছাড়া অর্থ পাচারে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ২০ শতাংশই কোনো না কোনোভাবেই পাচার হচ্ছে। তবে জিএফআই’র ২০১৯ সালের প্রতিবেদনের পর গত ৫ বছরে অর্থ পাচারের হিসাব ছিল আরও বেপরোয়া।

    এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে একটি ব্যাংক কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ব্যাংক খাত সংস্কারের মাধ্যমে টেকসই করতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে আর্থিক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি এবং সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করে তা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১০০ দিনের মধ্যে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গণমাধ্যমে দেওয়া ভাষণে জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি নামে-বেনামে ঋণের নামে কত টাকা আত্মসাত করে পাচার করেছেন, তার হিসাব করা হচ্ছে।
    বিশেষজ্ঞদের মতে, গত ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় মদদে অর্থ পাচার হয়েছে।

     



    তবে গত ৫ বছরে এই অর্থ পাচার বেড়েছে আগের দশ বছরের দ্বিগুণ। এই সময়ে প্রতিবছর লাখো হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞই সাধুবাদ জানিয়েছেন পাচারের অর্থ ফেরত আনা নিয়ে কাজ শুরু করেছেন বলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। তাদের মতে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষেই পাচারের এই অর্থ পুনরুদ্ধার সম্ভব। কারণ কোন রাজনৈতিক সরকারই চাইবেনা পাচারের অর্থ ফেরত আসুক।



    সূত্র মতে, পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই পুনরুদ্ধার কাজে সরকার ব্যাংকগুলোর নতুন ব্যবস্থাপনা পরিষদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ, পুলিশের সিআইডি ও দুদকের যৌথ সহায়তা নিচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা ও দেশের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবারও পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সুইজারল্যান্ডের সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত রেটো রেংগলি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি বিষয়টি উত্থাপন করেন। প্রফেসর ড. ইউনূস তার কাছে জানতে চান ‘টাকা ফেরতের কোনো উপায় আছে কি? চুরি করা অনেক টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে।’

    রাষ্ট্রদূত বলেন, এটি গুরুত্বপূর্ণ। পারস্পরিক আইনি সহায়তার বিষয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, সুইজারল্যান্ড সবসময়ই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি ও মানদÐ মেনে চলতে এবং সা¤প্রতিক বছরগুলোতে পেশ করা প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক। রাষ্ট্রদূত বলেন, তার কাছ থেকে সরকারের অগ্রাধিকার সম্পর্কে জানতে পারাটা ছিল আনন্দের। সামনে সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সুইজারল্যান্ড অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহায়তা করবে।

    এদিকে আত্মসাৎকারীদের সম্পদ অধিগ্রহণ ও পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে কাজ শুরুর বিষয়ে গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি পরিষ্কার বার্তা দিয়েছেন। সে বার্তায় বলা হয়েছে, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সা¤প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণের অর্থ আত্মসাত করেছেন এবং বিদেশে পাচার করেছেন। এর সঠিক পরিমাণ নির্ণয়ের কাজ চলমান আছে। এই আত্মসাত করা অর্থের পরিমাণ লক্ষাধিক কোটি টাকার ওপরে বলে ধারণা করা যায়। যদিও এটি ধারণাগত। বাস্তবে এই অঙ্ক অনেক বেশি। তাই প্রকৃত পরিমাণ কত তা নিরূপণে সরকার কাজ করছে বলে জানানো হয়।

    প্রধান উপদেষ্টার বার্তায় বলা হয়, এ ধরনের দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইতোমধ্যে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এরইমধ্যে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, গেøাবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। অবশিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করা হবে।

    অবশ্য দেশে-বিদেশে প্রভাবশালীদের অবৈধ সম্পদ বা পাচারকৃত অর্থের খোঁজে বিএফআইইউ কাজ করছে। বিএফআইইউ’র এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আর্থিক খাতের বিতর্কিত এস আলম, সামিট, বসুন্ধরা, ওরিয়ন, নাসাসহ অনেক গ্রæপের তথ্য চেয়ে একাধিক দেশে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আর সুনির্দিষ্ট তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশে। প্রভাবশালীদের হাতে থাকা ব্যাংকগুলো থেকে কী পরিমাণ অর্থ বের করে পাচার হয়েছে সেটি যাচাইয়েরও কাজ চলছে।

    সংস্থাটির অপর এক কর্মকর্তা বলেন, আলোচিত গ্রæপ অব কোম্পানির মালিকদের বিশেষ করে এস আলম গ্রæপের সাইফুল ইসলাম মাসুদ, সামিটের আজিজ খান, নাসা গ্রæপের নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর অর্থপাচারের আংশিক তথ্য বিএফআইইউ’র কাছে রয়েছে। এখন আরও বিস্তারিত তথ্য নেওয়ার কাজ চলছে। বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাদের বিষয়ে তথ্য পাওয়ার পর আইনি ব্যবস্থার সুপারিশ করা হবে। পাচার অর্থ ফেরত আনা সময়সাপেক্ষ হলেও দেশের সব সংস্থা মিলে জোর চেষ্টা করছে।

    অর্থপাচার ঠেকাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর আবুল কাশেম বলেছেন, আইন যেটা আছে, সেটা একেবারে অপ্রতুল না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমরা সবাই বিএফআইইউ’র দিকে তাকিয়ে থাকি। আসলে তাদের কাজটা হচ্ছে, কোনো অস্বাভাবিক লেনদেন বা টাকা পাচারের তথ্য পেলে সেটার অনুসন্ধান করা। তারপর তারা যে রিপোর্ট দেয় সেটা ধরে দুদক বা সিআইডি কাজ করে। তাহলে পাচার ঠেকানোর দায়িত্ব কার? এটার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু তারা সেটা সঠিকভাবে করছে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন।

    আরও খবর

    Sponsered content