নিউজ ডেস্কঃ ৭ আগস্ট ২০২৪ , ২:২০:৩৪ অনলাইন সংস্করণ
গণঅভ্যূত্থানের মুখে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা মানতে পারছেন না আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপিরা। তারা বলছেন, তিনি দেশ ছেড়ে যদি যাবেনই, তাহলে শেষ মুহূর্তে দলের নেতা-কর্মীদের কেন আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি দাঁড় করালেন? কেন দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে বিপদে ফেলে নিজের নিরাপত্তার জন্য ভারত গেলেন?
একজন নেতা গণমাধ্যমকে বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাতে পাক হানাদার বাহিনীর বন্দুকের মুখে দেশবাসীকে ফেলে রেখে শেখ মুজিবুর রহমান যেমন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রেফতার হয়ে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন; তেমনি শেখ হাসিনা মন মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে বিপদেফেলে পালিয়ে দিল্লি গেছেন। শেখ হাসিনা দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।
শেখ হাসিনা বোন রেহানাসহ ১৪ জনকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সাবেক মন্ত্রী এমপিরা গর্তে লুকিয়েছেন। এদের গ্রেফতারের ভয়ে কেউ ফোন ধরছেন না। তবে বিশেষ কৌশলে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, শেখ হাসিনা সোমবারই দেশ ছাড়বেন, এটা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি। এ ছাড়া তিনি পদত্যাগ করতে পারেন, এমন কোনো ইঙ্গিতও দেননি।
পালানোর কয়েক ঘন্টা আগেও তিনি দলের নেতাকর্মীদের উষ্কানি দিয়ে হুকুম দিয়েছেন, যাও আইন শৃংখলা বাহিনীর সঙ্গে ছাত্রদের প্রতিহত করো। আমি হুকুম দিলাম তোমরা ওদের (আন্দোলনকারী) শেষ করে দাও।
একজন নেতা বরেন, শেখ হাসিনা দেশ ছাড়বেন, ৫ আগন্ট দুপুরের দিকে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এমন খবর শোনার পর মন্ত্রিসভার সদস্য এবং দলের নেতা-কর্মীরা অনেকটা হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। এরপর মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য ও নেতা-কর্মী নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে থাকেন। অবশ্য পরিস্থিতির কারণে দু-একজন রোববার রাতে ও গতকাল সকালে দেশ ছেড়েছেন। কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের আগেই দেশের বাইরে পাঠিয়েছেন।
‘মা (শেখ হাসিনা) রাজনীতিতে আর আসবেন না’ সজিব ওয়াজেদ জয়ের এমন বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে একাধিক নেতা বলেন, তোমার মা রাজনীতিতে আসবে কি? তিনি দেশকে ধ্বংস করেছেন রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করেছেন। তিনি ১৫ বছরে যা করেছেন তাকে তার বিরুদ্ধে কয়েকশ মামলা হবে। শুধু তাই নয় তিনি বিদেশে পলাতক জীবন ছেড়ে দেশে এলে কয়েক জীবন তাকে কারাগারে থাকবে হবে।
এমনকি শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদের যেভাবে বিপদে ফেলে ভারত পালিয়েছেন; তিনি কখনো দেশে ফিরে আসতে পারলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাকে জুতাপেটা করবে।
সূত্র জানিয়েছে, শেখ হাসিনার ধরো-মারো নির্দেশনায় আস্বস্থ্য হয়ে বেশির ভাগ নেতা দেশেই ছিলেন। আন্দোলনের সময় যারা বিদেশ গেছেন তাদেরও কেউ কেউ দেশে ফিরে এসেছেন। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রহমান, ডাক, টোলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযু্িক্ত প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলকসহ বেশির ভাগ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতা ঢাকায় ছিলেন। ৫ আগন্ট সন্ধ্যার পরও কারো কারো মুঠোফোন খোলা ছিল। তবে বিকেলের দিকে ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবিরসহ অনেকের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। কেউ কেউ ধারণা করছেন, তারা হয় নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন, অথবা কোনো বাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন, নতুবা বিদেশে যাওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং ডাক, টোলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযু্িক্ত প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলক গতকাল বিদেশে পালাতে গিয়ে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ধরা পড়েন। জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে ৫ আগন্ট দুপুরে সংসদ এলাকাতেই দেখা গেছে। তবে এরপর তিনি কোথায় গেছেন, তা কেউ বলতে পারছেন না। বিকেলের পর থেকে তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীন, আপিল বিভাগের বিচারপতি এনায়েতুর রহিমসহ কয়েকজন বিচারপতি আত্মগোপন করেছেন।
ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, গণঅভ্যুত্থানের মুখে দলের সবাইকে বিপদে ফেলে শেখ হাসিনার পালানোর ঘটনায় তারা হতাশ, বিপর্যস্ত ও ভেঙে পড়েছেন। তারা মনে করছেন, শেখ হাসিনার একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত এবং জেদের কারণে দল ও নেতা-কর্মীরা বিপদে পড়েছেন। তিনি সব সময় আমিত্ব করেছেন। আমার বাবা দেশ স্বাধীন করেছে। আমি দেশের উন্নয়ন করেছি। আমি হেন করেছি, তেন করেছি। অহমিকায় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। শেখ হাসিনা সব সময় বলতেন ‘আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরাই আমার প্রাণ’। অথচ তিনি নিজের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও অন্যদের রেখে গেছেন বিপদে।
এখন দেশে শেখ হাসিনা ও তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো অস্থিত্ব নেই। জনতা সবকিছু গুড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ পরিচয় দিলেই পিটুনির মুখে পড়তে হয়।
সুত্র জানায়, শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল দিল্লিতে থাকেন। তার স্বামী খন্দকার মাসরুর হোসেন মিতুর দীর্ঘদিন থেকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের কারাগারে। সজিব ওয়াজেদ জয় থাকেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায়। তার ভিনদেশী স্ত্রী ক্রিস্টিনা ওভারমায়ার একমাত্র কন্যা সন্তান সোফিয়াকে নিয়ে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় পৃথক বাসায়।
আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, শেখ রেহানা গত রোববার সকালে লণ্ডন থেকে দেশে আসেন। গত সোমবার তাঁকে সঙ্গে নিয়েই পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। শেখ রেহানার ছেলে রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিও আগেই বাংলাদেশ ছেড়েছেন। রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকী যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের এমপি ও মন্ত্রী। তার বিরুদ্ধে বাসাভাড়ার নিয়ে তথ্য না দেয়ার অভিযোগে যুক্তরাজ্যে তদন্ত চলছে।
আওয়ামী লীগের একটি সুত্র জানায়, কয়েকজন মন্ত্রী গত রোববার রাতে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন; কিন্তু এটি আইনে নেই বলে তিনি উড়িয়ে দেন।
উল্টো শেখ হাসিনা আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে ব্যপক হত্যাযজ্ঞের নির্দেশনা দেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গণঅভ্যূত্থানে আইয়ুন খানের পতন হয়েছে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যাননি। এইচ এম এরশাদের পতন হয় গণ-অভ্যুত্থানে। কিন্তু তিনি দেশ ছেড়ে পালাননি; বরং জেলে গেছেন।
শেখ হাসিনা দেশের প্রধান একটি রাজনৈতিক দলের নেতা হয়ে কীভাবে নেতা-কর্মীদের রেখে বিদেশে চলে গেলেন, এটা মাথায় আসছে না।
শেখ হাসিনা গত কয়েক বছরে এমন অপকর্ম করেছেন যে দেশের নতুন প্রজন্ম শেখ হাসিনার নাম শুনলেই থুথু দেয়।