বদিউল আলম মজুমদার সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক ২২ আগস্ট ২০২৪ , ১:৪৬:৫৫ অনলাইন সংস্করণ
দুর্ভাগ্যবশত এ বিতর্কের সঙ্গে জড়িত রয়েছে অনেক অনভিপ্রেত ঘটনা। প্রতারণা, সংবিধান লঙ্ঘন ও স্বার্থপরতা, এমনকি পেশাগত অসদাচরণের মতো বিষয়। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত আমার লেখা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রাজনীতি বইয়ে এসব অপকর্ম ও অপরাজনীতির ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।
পাঠকদের স্মরণ আছে যে নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সারা দেশে যখন ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে, তখন ক্ষমতাসীন বিএনপির পক্ষ থেকে সংবিধানের দোহাই দিয়ে তা নাকচ করে দেওয়া হয়।
পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালের একটি একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংযোজন করে সংসদ থেকে সম্পূর্ণ নাটকীয়ভাবে পদত্যাগ করে বিএনপি।
পরবর্তী সময়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল–সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের এক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ২১ জুলাই সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারপারসন ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কো-চেয়ারপারসন করে ১৫ সদস্যের একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়, যাঁদের ১২ জনই ছিলেন আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। অন্য তিনজন ছিলেন আওয়ামী লীগের শরিক দলের নেতা। বিএনপিকে একজন সদস্যের নাম প্রস্তাবের জন্য বলা হলেও তারা তা করতে অস্বীকৃতি জানায়।
১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাসের পর এটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দুটি মামলা হয় এবং হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ যেগুলো খারিজ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বৈধ বলে রায় দেন। তবে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে ভবিষ্যতের জন্য অসাংবিধানিক ঘোষণা করে একটি সংক্ষিপ্ত, বিভক্ত আদেশ দেন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিরা।
একই সঙ্গে আদালত ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থা হিসেবে এবং রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের পক্ষে আদেশ দেন।
আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থেকে বিচার বিভাগকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার সংসদের ওপর ছেড়ে দেন। অর্থাৎ আদালত তাঁর সংক্ষিপ্ত আদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জীবন্ত রেখে পরবর্তী দুই নির্বাচন এর অধীনে অনুষ্ঠানের নিঃশর্ত অনুমতি দেন (প্রথম আলো, ২৮ আগস্ট ২০২৩)। যদিও আদালতের এই রায়কে ভন্ডুল করতে ২০১১ সালের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে বিচারপতি খায়রুল হকই হতেন এর প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সে সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার পর সংক্ষিপ্ত আদেশের প্রায় ১৬ মাস পরে প্রদত্ত বিস্তারিত রায়ে আদালত তাঁর ২০১১ সালের ১০ মের রায় বদলে দেন এবং পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠানের জন্য সংসদের অনুমোদনের শর্ত জুড়ে দেন, যা ছিল চরম প্রতারণামূলক এবং আদালতের সঙ্গে জালিয়াতির (ফ্রড-অন-দ্য কোর্ট) সমতুল্য। কারণ, সংক্ষিপ্ত আদেশই চূড়ান্ত রায়, যা পরিবর্তনযোগ্য নয় এবং বিস্তারিত রায়ে শুধু এর যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়।
এদিকে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন ও অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল রোধের লক্ষ্যে বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হলেও কমিটি পুরো সংবিধানকে পর্যালোচনা করে তা সংশোধনের সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
১০ মাসের মেয়াদকালে কমিটি ২৬টি বৈঠক করে এবং ১০৪ জন বিশেষজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী, সাবেক রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ রাজনীতিবিদদের পরামর্শ গ্রহণ করে ২০১১ সালের ২৯ মে তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার রেখেই সংবিধান সংশোধনের সর্বসম্মত সুপারিশ করে। প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীও বিশেষ কমিটির সামনে ২০১১ সালের ২৭ এপ্রিল হাজির হয়ে একই প্রস্তাব করেন।
কিন্তু ২৯ মে তারিখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষে সর্বসম্মত সুপারিশ প্রণয়নের পরদিন, ৩০ মে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর কমিটির সিদ্ধান্ত পাল্টে যায়। সংসদ কর্তৃক গঠিত একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটির সর্বসম্মত সুপারিশ নির্বাহী বিভাগের প্রধান কর্তৃক নাকচ করা সত্ত্বেও কমিটির কোনো সদস্য এর প্রতিবাদ করেননি। বরং কমিটির কো-চেয়ারপারসন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ করি। আওয়ামী লীগের নীতি ও সিদ্ধান্তই আমার নীতি ও সিদ্ধান্ত। শেখ হাসিনা আমার নেত্রী। এর বাইরে কিছু নেই’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১ জুন ২০১১)।
দুর্ভাগ্যবশত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছে শুধু উচ্চ আদালতের রায়ের জালিয়াতিমূলক অপব্যাখ্যার মাধ্যমেই নয়; বরং পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের আদালতের রায় অমান্য করেই।
উল্লেখ্য, বিশেষ সংসদীয় কমিটির সঙ্গে সাক্ষাতের পরদিন,Ñ অর্থাৎ ২০১১ সালের ৩১ মে প্রধানমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলন করেন, যাতে বলা হয়, ‘আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি…আদালত বাতিল করেছেন…আইনের শাসন মানলে আদালতের রায় মেনে চলতে হবে। রায়ের পর্যবেক্ষণ অংশে বলা হয়েছে, সংসদ মনে করলে পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আসতে পারে। তবে বিচার বিভাগকে জড়িত করা যাবে না’(প্রথম আলো, ১ জুন ২০১১)।
দুর্ভাগ্যবশত এ বক্তব্য সম্পূর্ণ প্রতারণামূলক। কারণ, পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে আদালত তাঁর ১০ মে ২০১১ তারিখে সংক্ষিপ্ত আদেশে সংসদের অনুমতির কোনো শর্ত দেননি। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থেকে শুধু বিচারপতিদের বাদ দেওয়ার বিষয়েই সংসদ কর্তৃক ত্রয়োদশ সংশোধনী সংশোধনের কথা রায়ে বলা হয়। অর্থাৎ একটি অপব্যাখ্যার ভিত্তিতে আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়।
পরবর্তী সময় ৮ জুন ২০১১ তারিখে স্পিকারের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দিয়ে এবং সংসদ বহাল রেখেই সংবিধান সংশোধনের চূড়ান্ত সুপারিশ পেশ করে, যার ভিত্তিতে ৩০ জুন তারিখে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী একতরফাভাবে সংসদে বা সংসদের বাইরে কোনোরূপ উল্লেখযোগ্য বিতর্ক ছাড়াই পাস হয়, যদিও সংবিধান ‘উইল অব দ্য পিপলের’ বা জনগণের অভিপ্রায়ের প্রতিফলন।
উচ্চ আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ভবিষ্যতের জন্য অবৈধ ঘোষণার ১৯ দিন পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য রেখেই সংবিধান সংশোধনের বিশেষ সংসদীয় কমিটির সর্বসম্মত সুপারিশ এবং পরদিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তা পাল্টে যাওয়া এবং এর এক মাসের মধ্যে, ৩০ জুন ২০১১ তারিখে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস ছিল চরম নাটকীয়তার মাধ্যমে গৃহীত এক প্রলয়ঙ্করী সিদ্ধান্ত।
এই সিদ্ধান্তের বিধ্বংসী প্রভাবে ২০১৪ ও ২০২৪ সালের একতরফা এবং ২০১৮ সালের চরম জালিয়াতির নির্বাচন আমাদের দেশে অনুষ্ঠিত হয়, যা আমাদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে ধ্বংস করে জাতিকে খাদের কিনারে নিয়ে এসেছে। প্রসঙ্গত, গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ, যা অলঙ্ঘনীয়।
দুর্ভাগ্যবশত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছে শুধু উচ্চ আদালতের রায়ের জালিয়াতিমূলক অপব্যাখ্যার মাধ্যমেই নয়; বরং পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের আদালতের রায় অমান্য করেই। তাই পঞ্চদশ সংশোধনী একটি অসাংবিধানিক সংবিধান সংশোধন। এটি অসাংবিধানিক সংবিধান সংশোধনী হওয়ার আরও কারণ রয়েছে। যেমন সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর সুবাদে গণভোট অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলক হলেও তা করা হয়নি।
এ ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭খ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদ অসংশোধনযোগ্য করা হয়। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুসরণ করে সংবিধান সংশোধন করা সংসদ সদস্যদের সাংবিধানিক অধিকার, যা খর্ব করা যায় না, অর্থাৎ এক সংসদ ভবিষ্যৎ সংসদের অধিকার হরণ করতে পারে না।
এসবই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রাজনীতি গ্রন্থের বিষয়বস্তু। এসব বিবেচনায় আমরা কয়েকজন ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার আপিল বিভাগের রায়ের রিভিউ ও পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের লক্ষ্যে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি।