ভাটি বাংলা ডেস্ক: ২৬ আগস্ট ২০২৪ , ২:২৭:২৪ অনলাইন সংস্করণ
পতিত সরকারের দুর্নীতি-অনিয়ম ও অর্থ পাচারে দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক, রাজস্ব আহরণ, রফতানি বাণিজ্য, ডলার সংকট ও রিজার্ভ পরিস্থিতি ভয়াবহ। ঋণের পর্বত, লুটপাটের ক্ষত, দুর্নীতির বোঝা, পাচারের তেজ, রিজার্ভ বিপর্যয়সহ নানা সংকট রেখে কেবল ছোটবোনকে নিয়ে পালিয়ে জানে বেঁচেছেন শেখ হাসিনা।
পরিবারের বাদবাকিদের পাঠিয়ে দিয়েছেন আরো আগেই। তার কাছে এই পরিবারই আওয়ামী লীগ, তারাই বাংলাদেশ।
নানা ছলে বিরোধীদের নিপীড়ন, আবেগি কথায় নিজদলের কর্মীদের কিছু উচ্ছিষ্ট খাইয়ে টানা সাড়ে ১৫ বছরে অবিরাম ঠকবাজির চাতুরিতে দেশের যতো সর্বনাশ করা যায়, তার একটিও বাদ দেননি তিনি। উন্নয়নের নামে মেগা প্রকল্পে চলেছে মেগা লুটপাট। নানা ঘটনায় আরো স্পষ্ট ছিল উন্নয়নে নয়, প্রকল্পগুলো নেয়াই হয়েছিল লুটপাটের উদ্দেশ্যে।
অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে ঋণের টাকার বড় অংশ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নানা প্রক্রিয়ায় একটি চক্রকে দিয়ে চালানো হয়েছে পাচারের কাজটি। সরকারের টপ টু বটম কম-বেশি এ কর্মে লিপ্ত ছিল। বিদেশি একটি গণমাধ্যমে এসেছে, লুটপাট-দুর্নীতি-অনিয়মের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রকল্পের অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে।
স্বয়ং শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিক মালয়েশিয়ার ব্যাংকের মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেই ৫ বিলিয়ন ডলার বা ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাতের অংকই প্রায় ৫৯ হাজার কোটি টাকা।
পালানোর সময় তিনি বাংলাদেশের জনগণের ঘাড়ে রেখে গেছেন ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি (১৮৩৬০০০ কোটি) টাকার বৈদেশিক ঋণ। এখন তা সামলানোর সরাসরি দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের। বড় জোর একটু একটু সময় নেয়া যাবে।
কিন্তু, মাপ নেই। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতারোহণের সময় দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি (২৭৬০০০ কোটি) টাকা। ১৫ বছরে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ১৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। সুদ-আসলে এই ঋণ শোধের দায় চেপেছে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের ঘাড়ে।
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বভ্রমা-ে অর্থনীতির এক বরেণ্যজন। তার স্যোশাল বিজনেসে ধন্য সুদূরের যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিকট দেশ ভারত পর্যন্ত। তার থিউরি কাজে লাগিয়ে তারা নিজ নিজ দেশে বেনিফিসিয়ারি।
সেই ব্যক্তিটিই এখন এক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার দায়িত্বপ্রাপ্ত। বিগত সরকারের কুকীর্তির ভার তার ওপর।
দু’বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে দেশের মানুষের জীবনযাত্রা অসহনীয়। এ সময়টাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমেছে। ডলার-সংকটে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। খেলাপি ঋণ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
তাদের কুকর্মের জেরে বর্তমানে কয়েকটি ব্যাংক বেঁচে আছে বিশেষ কোরামিনে। প্রকল্পের অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে ঋণের টাকা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আবার পাচারের ঘটনাও ছিল পরিকল্পিত।
আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বাজেট সহায়তার জন্য বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঋণ নেয়। বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকেই সবচে বেশি ঋণ নিয়েছে। পাবলিক ও প্রাইভেট মিলিয়ে ২০১৭ সালের শেষে বাংলাদেশের সার্বিক মোট ঋণ ছিল ৫১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে এটি পৌঁছে ১০০ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারে।
অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ বেশ ক’বছর ধরে ক্রমেই বাড়ছে। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে এ ঋণ নিয়েছে সরকার। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণের মধ্যে একটি উৎস হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, আরেকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের অর্থই হচ্ছে টাকা ছাপানো।
এতে বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে যায়, যা উসকে দেয় মূল্যস্ফীতিকে। দেশি ও বিদেশি দুই ধরনের ঋণের প্রতিই ঝুঁকেছিল আগের সরকার। শেষ ছয়-সাত বছরে দ্রুত হারে উভয় ধরনের ঋণ নেওয়া বেড়েছে এবং বেশি বেড়েছে দেশি ঋণ। নিজস্ব অর্থায়নে বলে প্রচার চালানো হলেও পদ্মাসেতুও বিদেশি ঋণ নিয়েই হয়েছে। সামনে আসছে ঋণ পরিশোধের চাপ।
আগামী বছরের পর থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সুদ দেওয়া শুরু করতে হবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ-ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ১৫ বছরে বিদেশি ঋণের বোঝা বেড়েছে তিন গুণের বেশি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে পুঞ্জীভূত বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৮৫ কোটি ডলার। আওয়ামী লীগ সরকার কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পাশাপাশি রেল ও বিদ্যুৎ খাতে ভারত, চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে কঠিন শর্তের ঋণও নেয়। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে অর্থাৎ গত জুন মাস শেষে সরকারের পুঞ্জীভূত বিদেশি ঋণ দাঁড়ায় ৬ হাজার ৭৯০ কোটি ডলারে। সে হিসাবে বর্তমানে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মাথার ওপর গড়ে ৪০০ ডলারের মতো বিদেশি ঋণের বোঝা।
আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বাজেট সহায়তার জন্য বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঋণ নেয়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকেই সবচে বেশি ঋণ নিয়েছে। পাবলিক ও প্রাইভেট মিলিয়ে ২০১৭ সালের শেষে বাংলাদেশের সার্বিক মোট ঋণ ছিল ৫১.১৪ বিলিয়ন ডলার ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে এটি ১০০.৬৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধির সাথে সাথে এর সুদ এবং আসল পরিশোধের পরিমাণ প্রতিবছর বাড়ছে। এর কী ভয়ানক জের পড়তে পারে, এ সম্পর্কে শেখ হাসিনার সরকারকে বারবার সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু, সরকারের দিক থেকে তাদের বিএনপি-জামায়াতের লোক চিহ্ন দিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা চলেছে। তাদের দমানো গেলেও তথ্য চাপা রাখা যায়নি। বাংলাদেশের কার কাছে কতটা ঋণ রয়েছে সেই বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট ডাটা পাওয়া যায়।
এ সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ঋণ ছিল ৫৫.৬০ বিলিয়ন ডলার। এই ঋণের অর্ধেকের বেশি ৫৭ ভাগ হলো বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছে। আর দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে ঋণ করেছে তার মধ্যে জাপান, রাশিয়া, চীন ও ভারত এই চারটি দেশই প্রধান। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বেলায় বাংলাদেশের দেনা সব চেয়ে বেশি জাপানের কাছে। পরিমাণ ৯.২১ বিলিয়ন ডলার। এরপরই রাশিয়ার কাছে ৫.০৯ বিলিয়ন, চীনের কাছে ৪.৭৬ বিলিয়ন এবং ভারতের কাছে ১.০২ বিলিয়ন ডলার ঋণী বাংলাদেশ। বর্তমানে এ ঋণ আরো অনেক বেশি। কারণ, ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ৫শ ৬৩ কোটি ডলার ঋণ করেছে। এর মধ্যে সবচে বেশি এডিবি থেকে ১৪০ কোটি এবং বিশ্বব্যাংক থেকে ৯৬ কোটি ডলার। একই সময়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতায় জাপান থেকে ১৩৫ কোটি, রাশিয়া থেকে ৮০ কোটি, চীন থেকে ৩৬ কোটি, ভারত থেকে ১৯ কোটি এবং অন্যান্য উৎস থেকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে। এসবের পুরো চাপ এখন ইউনূস সরকারের ঘাড়ে। শেখ হাসিনা বা আগের সরকার এসব করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে, তাই এখনকার সরকার সেই দায় নেবে নাÑ এমন বাঙালিপনার সুযোগ নেই।
বিশ্ব অর্থনীতিতে তা ভাবাও যায় না। দেনার সেই দায় এখন দেশকে, দেশের প্রতিটি নাগরিককে, বিশেষ করে ইউনূস সরকারকে নিতে হবে। এটাই নিয়ম। প্রকারান্তরে বিদেশি ঋণের সমস্ত দায় শেষ পর্যন্ত জনগণের কাঁধেই পড়ে। জনগণের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আদায় করেই সরকারের আয় বাড়াতে হবে। এখন মাথাপিছু ঋণ দেড় লাখ টাকার মতো। কিছুদিন আগে এটা এক লাখ টাকার মতো ছিল। সরকারকে কোনো না কোনোভাবে প্রত্যকের কাছ থেকে তা আদায় করতে হবে। তা করতে গিয়ে কে কীভাবে এর শিকার হবে এবং হচ্ছে, বাজার পরিস্থিতিই তা বলে দিচ্ছে। ড. ইউনূস তথা অন্তর্বর্তী সরকারের আর একটি বড় কাজ হলো রাষ্ট্রের ভিতর থাকা দুর্বৃত্তচক্র এবং দুর্নীতিবাজদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা। এই চক্রদের যদি চিহ্নিত না করা যায়, নির্মোহভাবে যদি এদের বিচার না হয় তাহলে যে বিপ্লব নিয়ে আমরা গর্ববোধ করছি তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। অতীতে সব সরকারই দুর্নীতিকে রাজনৈতিক ফায়দা আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। কখনওই দুর্নীতির নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি। সবসময় বিরোধী মতকে চাপে ফেলার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে ব্যবহার করেছে। লক্ষ করা যাচ্ছে, জুলাই বিপ্লবের পর নতুন সরকার হত্যার বিচারে যত মনোযোগী, দুর্নীতির ব্যাপারে ততটা নয়।
এখন পর্যন্ত গত ১৫ বছরে লুণ্ঠনের জন্য কোনো কমিশন হয়নি। পুনর্গঠন করা হয়নি দুর্নীতি দমন কমিশন। বিভিন্ন স্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার পুরাতন নাটক মঞ্চস্থ করছে। এতে অতীতের মতো দুর্নীতিবাজরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে হয়তো।
বছরের পর বছর চলবে বিচারের নামে কালক্ষেপণ। দুর্নীতিবাজরা আবার সংগঠিত হবে। তাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র বিপ্লবের ফসল ঘরে তুলতে হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিকল্প নেই।
মনে রাখতে হবে, জুলাই হত্যাকা- এবং ১৬ বছরের দুর্নীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পর্কিত। কেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে এভাবে পৈশাচিক কায়দায় দমনের চেষ্টা করেছিল পতিত সরকার? কারণ, সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।
জনগণের ক্ষোভ-দুঃখ-বেদনাগুলো সরকারের কাছে পৌঁছানোর সব দরজা ছিল বন্ধ। সরকার কেন জনবিচ্ছিন্ন হলো? কারণ, সরকার দেশ শাসন করেছিল কোনো বৈধ ম্যান্ডেট ছাড়া, ভোট ছাড়া। নানা কূটকৌশলে তারা ‘ক্ষমতা’কে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল।
ক্ষমতায় আজীবন থাকার এই সর্বগ্রাসী মানসিকতায় কেন আচ্ছন্ন হয়েছিল? কারণ দুর্নীতি। দুর্নীতির জন্যই সরকার ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল। দুর্নীতি ঢাকার জন্যই সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করার কাজে লিপ্ত ছিল।
অবাধে লুণ্ঠনের জন্যই সরকার একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছিল। দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্যই সরকার সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছিল। দুর্নীতিই আসলে সরকারকে স্বৈরাচার করেছিল, করেছিল হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। দুর্নীতির কারণেই তারা রীতিমতো দানবে পরিণত হয়েছিল।
অন্তর্বর্তী সরকার তথা ড. ইউনূস এখন কোন ক্যারিশমায় এ বিষয়গুলোতে সমাধানের পথে আগাবেন, তা অপেক্ষা করে দেখার বিষয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
rintu108@gmail.com