,আকবর হোসেন, বিবিসি নিউজ বাংলাঃ ৩১ জুলাই ২০২৪ , ২:৫৬:২৫ অনলাইন সংস্করণ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার আলোচনা আবারো শুরু হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করেছে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সহচর কিছু দল, যারা একত্রে ‘১৪ দলীয় জোট’ হিসেবে পরিচিত।
জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সে বৈঠকে আওয়ামী লীগ ও তাদের রাজনৈতিক সহযোগীরা ‘একমত’ হয়েছে। তারা বলছেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে রাজনৈতিকভাবে তাদের মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। এখন এ বিষয়ে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে ২০১২ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও মন্ত্রীরা অসংখ্যবার জামায়াতে ইসলামীকে ‘নিষিদ্ধ’ করার কথা বলেছেন। কিন্তু সেটি গত ১২ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি।
জামায়াতে ইসলামীকে কোন প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ করা হবে সেটি নিয়ে সরকারের মধ্যে নানা আলোচনা চলছে। বুধবার সরকারের একাধিক মন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করেছেন।
মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ১৪ দল যে কথা বলছে, সেটি বাস্তবায়ন করবে সরকার।
“বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কী হবে তার আইনগত দিক দেখেশুনে সরকার শিগগিরি পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে। আমরা আইনগত দিকটি ভালোভাবে দেখে নিতে চাই। যাতে কোন ফাঁকফোকর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে এই অপশক্তি আর কোন সুযোগ না পায়,” বলছিলেন ওবায়দুল কাদের।
জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে গত ১২ বছর যাবত সরকারের ভেতরে কয়েকটি উপায় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও এই ধারণাই দিয়েছেন।
একটি হচ্ছে, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আদালতে আবেদনের মাধ্যমে হতে পারে।আরেকটি বিকল্প হচ্ছে, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে।
এছাড়া সংসদেও সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। সব কটি বিকল্প বিবেচনা করছিল ক্ষমতাসীনরা। কিন্তু এই ইস্যুতে কোন অগ্রগতি হয়নি।
আদালতের মাধ্যমে নিষিদ্ধ হতে হলে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার হতে হবে। সেক্ষেত্রে আইন সংশোধনের প্রয়োজন।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের ধারণা দিয়েছেন, সরকার হয়তো নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করবে।
“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আগামীকালের মধ্যে একটা ব্যবস্থা নেয়ার। কোন আইনি প্রক্রিয়ায় হবে সেটা আমরা যখন সিদ্ধান্ত নেব তখন বলবো। যদি এই দলটাকে নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে দেশের আইনশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে।”
“যখন (কোন দল) নিষিদ্ধ হয় তখন নির্বাহী আদেশে হয়, বিচার বিভাগীয় আদেশে হয় না, ” সাংবাদিকদের বলেন আইনমন্ত্রী।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতারা এখন হয়তো কারাগারে, নয়তো অনেকটা আত্মগোপনে রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য দলটির কোন নেতাকে পাওয়া যায়নি।
তবে জামায়াতে ইসলামীর তরফ থেকে মঙ্গলবার একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে। সে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ১৪ দলীয় জোট কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা।
“একটি রাজনৈতিক দল বা জোট অন্য একটি রাজনৈতিক দলের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বাংলাদেশের আইন ও সংবিধান কাউকে এ এখতিয়ার দেয়নি। কোনো দল বা জোট অন্য কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার ধারা চালু হলে এক দল অন্য দলকে নিষিদ্ধ করতে থাকবে। তখন রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বলে কিছু থাকবে না,” জামায়াতে ইসলামীর বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী নিজেদের একটি ‘গণতান্ত্রিক সংগঠন’ হিসেবে দাবি করে বলছে, এ ধরনের নিষিদ্ধ করার দাবি বেআইনি, এখতিয়ার বহির্ভূত ও সংবিধান পরিপন্থী।
দলটি বলছে, ছাত্র বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে সরকার নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর দায় চাপাচ্ছে।
“রাষ্ট্র-যন্ত্র ব্যবহার করে জামায়াত ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের উপর দোষারোপ করে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে,” জামায়াতে ইসলামীর বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা সীমিত রয়েছে গত এক দশকের বেশি সময় যাবত।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয় বন্ধ রয়েছে বছরের পর বছর ধরে। দলটির নেতা-কর্মীরা কোন বাসায় বসলেও সেখানে পুলিশর হানা দেয়া ও গ্রেফতারের খবর প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
২০১৩ সালের ১০ই জুন এক দশক পর ঢাকায় প্রকাশ্যে সমাবেশ করেছিল জামায়াতে ইসলামী।
এমন অবস্থায় জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টিকে ‘হাস্যকর’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সালাহউদ্দিন বাবর।
তিনি মনে করেন, গত ১৫ বছর যাবত জামায়াতের ইসলামী যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তাতে দলটিকে নিষিদ্ধ করা কিংবা না করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
“তাদেরকে নিষিদ্ধ করা হলো কি হলো না, দ্যাট ডাজ নট ম্যাটার (এটা কোন ব্যাপার না),” বলছিলেন মি. বাবর। তিনি মনে করেন, ছাত্র বিক্ষোভ দমাতে গিয়ে যে পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে সেখান থেকে ‘দৃষ্টি ভিন্ন দিকে’ নেয়ার জন্য জামায়াতে ইসলামীর ইস্যুটিকে ক্ষমতাসীনরা সামনে এনেছে।
তবে নিষিদ্ধ করার পর এর একটি আইনগত ভিত্তি হয় বলে উল্লেখ করছেন পর্যবেক্ষকরা। তখন কোন ব্যক্তি জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ফেসবুক কিংবা অন্য কোনভাবে প্রচারণা চালায় তখন তাকে আইনের আওতায় আনতে পারবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এছাড়া কোন ব্যক্তি যদি জামায়াতে ইসলামীকে আর্থিক সাহায্য করে তাহলে তাকেও আইনের আওতায় আনা যাবে।
কারণ, নিষিদ্ধ সংগঠনের পক্ষে প্রচারণা চালানো এবং তাদের আর্থিক সহায়তা করা দণ্ডনীয় হিসেবে বিবেচিত হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলছেন, কোন সংগঠন নিষিদ্ধ হবার পর সেই সংগঠনের ব্যানারে কোন সভা-সমাবেশ কিংবা অন্য কোন ধরনের তৎপরতা চালানো যায়না।
এ ধরনের কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে গেলে সরকার তাদের আইেনর আওতায় আনতে পারবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
২০১৩ সালের ১লা আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ বলে ঘোষণা করেছিল হাইকোর্ট। বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন না থাকলে কোন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না।
হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলও খারিজ হয়ে যায় ২০২৩ সালের ১৯শে নভেম্বর। জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন না থাকলেও রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা নিষিদ্ধ ছিল না।
সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে মানবতা-বিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে তদন্ত সংস্থা ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্র-পক্ষের প্রধান কৌঁসুলির কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর পর ১০ বছর পার হলেও সে বিচার এখনো শুরু হয়নি।
২০১৯ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হবে কি না সেটি জানতে আদালতের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তখন তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন, রায় শিগগির হবে।
“তাদের নিষিদ্ধ করবার জন্য ইতিমধ্যে কোর্টে একটি মামলা রয়ে গেছে। সেই মামলার রায়টা যতক্ষণ পর্যন্ত না হবে, সেখানে বোধ হয় আমরা কোন কিছু করতে পারি না। আমি আশা করি কোর্টের রায় খুব শীঘ্র হয়ে হয়ে যায়, তাহলে জামাত তারা দল হিসেবে নিষিদ্ধ হবে।,” সংসদে বলেছিলেন শেখ হাসিনা।
তবে প্রধানমন্ত্রী কোন মামলার কথা বুঝিয়েছেন সেটি তিনি পরিষ্কার করে বলেননি। প্রকৃতপক্ষে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার জন্য আলাদা কোন মামলা হয়নি।
২০১৬ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামীর বিচার করার জন্য উপযুক্ত আইন থাকতে হবে।
“ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩ সংশোধন করা হচ্ছে। এটা মন্ত্রীপরিষদের অ্যাপ্রুভালের জন্য অপেক্ষমাণ,” বলেন আইনমন্ত্রী
এরপর ২০২৩ সালের ১১ই জুন আনিসুল হক ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে আবারো একই উত্তর দেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, “জামাতকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করার জন্য যে আইন সংশোধন করার কথা আমি আগে বলেছি সে প্রক্রিয়া কিন্তু চলমান। এবং সংশোধনের জন্য আইনটা ক্যাবিনেটে কিছুদিনে মধ্যে যাবে।”
এর আগে ২০১৩ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি বিবিসি বাংলার এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৭২ সালের সংবিধানর ৩৮ ধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয় সেই হিসাবে জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ডও নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। এরপর প্রথমে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ হিসাবে আরো কয়েকটি দলের সাথে জামায়াতে ইসলামী আবার কর্মকাণ্ড শুরু করে। তবে ১৯৭৯ সাল থেকে নিজেদের নামেই কর্মতৎপরতা শুরু করে।
সূত্রঃ বিবিসি বাংলা