ডেস্ক রিপোর্টঃ ১৪ জুন ২০২৪ , ৩:২৮:১৯ অনলাইন সংস্করণ
নরেন্দ্র মোদি গত ৯ জুন ধারাবাহিকভাবে তৃতীয় বারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পদে শপথ গ্রহণ করেন। তিনি ছাড়া ভারতীয় জনতা পার্টি এবং এনডিএ জোটের অন্যান্য সহযোগী দলের সদস্য মিলিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ৭১ জন শপথ গ্রহণ করেছেন।
গত দুই মেয়াদের তুলনায় এখনো পর্যন্ত এটাই ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) সরকারের সবচেয়ে বড় মন্ত্রিপরিষদ। তবে এই বিরাট আয়তনের নবনির্বাচিত মন্ত্রিসভায় কোনো মুসলিম মন্ত্রী নেই।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো মুসলিম সংসদ সদস্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় শপথ নেননি।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও বিরোধী দলের নেতারা মনে করেন, দেশের রাজনীতিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার এই প্রবণতা কিন্তু উদ্বেগজনক।
যদিও এই অভিযোগ মানতে নারাজ বিজেপি। তাদের দাবি, বিজেপি ধর্ম বা বর্ণের ভিত্তিতে ভোটের টিকিট দেয় না এবং তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পটভূমি নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণের স্বার্থে কাজ করে থাকেন।
মন্ত্রিপরিষদ কাঠামো
অষ্টাদশ লোকসভায় বিজেপির ঝুলিতে এসেছে ২৪০টি আসন। আর তাদের এনডিএ জোটের শরিকদের কাছে রয়েছে ২৯৩টি আসন।
গত রোববার প্রধানমন্ত্রীসহ মোট ৭২ জন মন্ত্রিসভার সদস্য শপথ নিয়েছেন। এর মধ্যে ৬১ জন সদস্য বিজেপির এবং ১১ জন সদস্য এনডিএ-র শরিক দলের।
২০১৪ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। ওই বছর মন্ত্রিসভায় ২৪ জন ক্যাবিনেট পদমর্যাদাসহ মোট ৪৬ জন সদস্য ছিলেন।
মোদির দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন ২০১৯ সালে। ওই দফায় মন্ত্রীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭।
এইবার ওই সংখ্যা আরো বেড়ে দাঁড়িয়েছে মোট ৭২ জন। তবে নতুন সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান পায়নি কোনো মুসলিম সদস্য। ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম এমন ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর কিরেন রিজিজুকে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
কিরেন রিজিজুর পাশাপাশি জর্জ কুরিয়েনকেও তার দফতরে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কেরালার বিজেপি নেতা জর্জ কুরিয়ান খ্রিস্টান।
২০১৯ সালে, প্রধানমন্ত্রী মোদি দলের রাজ্যসভার সাংসদ মুখতার আব্বাস নকভিকে সংখ্যালঘু বিষয়ক বিভাগের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, যদিও তিনি ২০২২ সালে পদত্যাগ করেন। এরপর বিজেপির স্মৃতি ইরানিকে সংখ্যালঘু বিষয়ক দফতরের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়।
কাজেই সেদিক থেকে দেখতে গেলে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই (২০২২ সাল থেকে) বিজেপি সরকারের মন্ত্রিপরিষদে কোনো মুসলিম মন্ত্রী ছিলেন না, সংসদ সদস্যদের কোনো কক্ষেই কোনো মুসলিম নেই।
তা ছাড়া তথ্য বলছে, গোটা দেশে বিভিন্ন বিধানসভায় বিজেপির এক হাজারের বেশি বিধায়ক থাকলেও মুসলিম বিধায়ক রয়েছেন মাত্র একজনই।
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার ১৭.২২ কোটি মানুষ মুসলমান সম্প্রদায়ের এবং এই অঙ্কটা মোট জনসংখ্যার ১৪.২ শতাংশ।
অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে ২৪ জন মুসলিম সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন, যার মধ্যে ২১ জন বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার শরিক দলের।
ভারতীয় জনতা পার্টিতে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব হ্রাসের বিষয় নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয়েছে বিরোধী দল এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
গত ৩ মে কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুসলিমদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। দেশে এই প্রথম লোকসভা ও রাজ্যসভায় একজনও মুসলিম সংসদ সদস্য নেই।’ ‘মন্ত্রিসভাতেও কোনো মুসলিম মন্ত্রী নেই। বিজেপি যা করেছে সেটা ভুল।’
তিনি আরো বলেন, পূর্ববর্তী কংগ্রেস সরকারের আমলে দেশের জনসংখ্যার ভিন্ন ভিন্ন স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল।
যদিও বিজেপির পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে বিষয়টিকে নজরে রাখা হয়েছে তা হলো প্রার্থীর ‘জেতার ক্ষমতা’ আছে কি না।
একইসাথে বিজেপি এই অভিযোগও অস্বীকার করেছে যে- তারা মুসলিমদের ভোটের টিকিট দিতে চায় না।
অমিত শাহ ২০২২ সালে এক ভাষণে এই অভিযোগ খারিজ করে দিয়ে বলেছিলেন, তার দলে নির্বাচনি টিকিট দেয়ার ভিত্তি হলো প্রার্থীর ভোটে জেতার ক্ষমতা। সেই সময় দেশের বিভিন্ন বিধানসভায়, বিশেষত উত্তরপ্রদেশে একজনও মুসলিম প্রার্থীকে টিকিট না দেয়ার যে প্রশ্ন উঠেছিল, তার প্রেক্ষিতে তিনি তার দলের হয়ে কথা বলতে গিয়ে এই ব্যাখ্যা করেছিলেন।
উত্তরপ্রদেশে চার কোটি মুসলিম রয়েছে এবং তারা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ।
বিষয়টা এমন নয় যে বিজেপি এর অতীতে কখনো মুসলিম প্রার্থীদের ভোটের টিকিট দেয়নি। কিন্তু গেরুয়া শিবিরে নির্বাচনি টিকিট পাওয়া মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা ক্রমশ কমতে কমতে শূন্যতে গিয়ে ঠেকেছে।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সাতজন মুসলিম প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। ২০১৯ সালে ছয়জন মুসলিম প্রার্থীকে টিকিট দিয়েছিল বিজেপি।
তবে ২০১৪ ও ২০১৯ সালে বিজেপির একজন মুসলিম প্রার্থীও নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি। এবারের লোকসভা ভোটে বিজেপি একজন মুসলিম প্রার্থীকেই টিকিট দিয়েছিল।
বিজেপির টিকিটে ভোটেব লড়ে লোকসভায় পৌঁছানো শেষ মুসলিম সাংসদ ছিলেন শাহনওয়াজ হুসেন। ২০০৯ সালে ভোটে জিতেছিলেন তিনি।
শাহনওয়াজ হুসেন মনে করেন, হাতে গোনা কয়েকজন মুসলিম প্রার্থীকে ভোটে টিকিট দেয়া হলেও যারা নির্বাচনে জিতেছেন তাদের নিশ্চিত করা উচিৎ যে সমস্ত সম্প্রদায়ের উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেন কোনোভাবেই বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ না নেয়া হয়।
বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিজেপি মুখপাত্র ও রাজ্যসভার সাবেক সংসদ সদস্য জাফর ইসলাম বলেন, ‘কংগ্রেস ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলো বিজেপিকে হারাতে এবং তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য মুসলিমদের ব্যবহার করছে।’
এই প্রসঙ্গে তার পালটা যুক্তি, ‘কোনো দল যদি কোনো মুসলিম প্রার্থীকে টিকিট দেয় এবং মুসলিমরা যদি তাকে ভোট না দেন, তাহলে কোনো দল তাদের টিকিট দেবে?’
ভারতের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে মুসলিম জনসংখ্যার নিরিখে সংসদে কিন্তু মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব ছিল না। নির্বাচনে মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পেলেও সংসদে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব পাঁচ শতাংশের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মুসলিম প্রার্থী ছিলেন ১১৫ জন, ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৭৮।
তবে মোদি সরকার তাদের মন্ত্রিসভায় একজন খ্রিস্টান মন্ত্রী এবং দুজন শিখ মন্ত্রীকে জায়গা দিয়েছে।
সংসদ সদস্য জর্জ কুরিয়েন নবনির্বাচিত মন্ত্রিপরিষদের খ্রিস্টান মন্ত্রী। হরদীপ সিং পুরী এবং রভনীত সিং বিট্টু শিখ সম্প্রদায়ের।
প্রসঙ্গত, রভনীত সিং বিট্টু কিন্তু বর্তমানে লোকসভা বা রাজ্যসভার সদস্য নন। এবার লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বিট্টুকে টিকিট দিলেও তিনি ভোটে হেরে যান।
এবারের মন্ত্রিসভায় সমাজের অন্যান্য বঞ্চিত গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সামিল করা হয়েছে। ইংরেজি সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোদি সরকারের তৃতীয় দফায় মন্ত্রিসভায় ১০ জন দলিত, ২৭ জন অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি এবং পাঁচজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সংসদ সদস্য রয়েছেন।
সূত্র : বিবিসি