আল-হেলাল সুনামগঞ্জ: ১৯ মার্চ ২০২৪ , ৭:৪৯:২৯ অনলাইন সংস্করণ
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদীতে একদিকে চলছে নদীর পাড় কাটা অন্যদিকে বোমা মেশিন ও ড্রেজারের তান্ডব চলছে।
সুনামগঞ্জ ১ আসনের সাবেক সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের ছত্রছায়ায় থেকে সাবেক চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিন বরাবরের মতো এখনও বোমা মেশিন ও ড্রেজারের তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৫০০ একর জায়গা ইজারা নিয়ে যাদুকাটা নদীর প্রায় চার কিলোমিটার এলাকায় ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু ও পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ভূক্তভোগীরা।
এলাকাবাসীর তীব্র প্রতিবাদ উপেক্ষা করে বালু ও পাথর উত্তোলনে পরিবেশবিনাশী ড্রেজার ও সেইভ মেশিনের ব্যবহার হচ্ছে দেদারছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে নদী, পরিবেশ ও তীরবর্তী মানুষের জীবন। যাদুকাটা-১ ও যাদুকাটা-২ বালুমহালের প্রায় ৫০০ একর জায়গা জেলা প্রশাসন থেকে ইজারা নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু ইজারাপ্রাপ্ত এলাকার বাইরে গিয়ে নদীর পূর্বপাড় মিয়ারচর আর পশ্চিমপাড় পাটানপাড়া বাজার থেকে লাউড়েরগড় পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকা থেকে বালু ও পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, সনাতন পদ্ধতিতে হাত, বালতি, বেলচা দিয়ে বালু উত্তোলনের কথা থাকলেও এখন ব্যবহার হচ্ছে ড্রেজার এবং শ্যালো ইঞ্জিনচালিত সেইভ মেশিন। এসব দিয়ে নদী তীরবর্তী এলাকায় গভীর গর্ত করে রাখা হচ্ছে।
বর্ষায় মেঘালয় পাহাড়ে ভারি বৃষ্টি হলেই এখনকার গ্রাম, ফসলি জমি ও সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাসহ রাস্তাঘাট হুমকির মুখে পড়বে অনায়াসে।
এ বছর যাদুকাটা-১ বালুমহাল ২৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকায় রতন মিয়ার মালিকানাধীন সোহাগ এন্টারপ্রাইজ এবং যাদুকাটা-২ বালুমহাল ৪২ কোটি ৯০ লাখ ৫০ হাজার টাকায় খন্দকার মঞ্জুরের প্রতিষ্ঠান আরাফ ট্রেড করপোরেশন লিমিটেড ইজারা নিয়েছে। মোট ৬৮ কোটি ৬৫ লাখ ৫০ হাজার টাকায় এ দুটি বালুমহাল আলাদাভাবে ইজারা গ্রহন করলেও দুই ইজারাদার ও তাদের ভাগীদাররা একসঙ্গে নদীর ইজারা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
অথচ ২০০৯ সালে পরিবেশের ক্ষতির কথা চিন্তা করে সরকার পাথর উত্তোলন বন্ধ করে দেয়। কারণ ফাজিলপুরের যে জায়গা থেকে বোল্ডার, ভূতু পাথর ও নুড়ি উত্তোলন করা হত, ক্রমান্বয়ে সেই জায়গাটিই বিলীন হয়ে যায়। জেলা প্রশাসন পাথর উত্তোলনের জন্য কোনো জায়গা ইজারা না দিলেও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৭৭ একর জায়গা থেকে অবাধে তিন ধরনের পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, “যে হারে নদীতে ড্রেজার ও সেইভ মেশিন দিয়ে তান্ডব চালানো হচ্ছে, এতে নদী তীরবর্তী গ্রাম-হাওর, পরিবেশ, প্রতিবেশ, জনজীবন ও জনবসতি বিপন্ন হবে।” জানা যায়,সিলেট বিভাগের সাতটি বালুমহলের ছয়টির ইজারা বন্ধ থাকলেও শুধু যাদুকাটার বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে।
এই ইজারাপ্রথা চালু রাখা ‘রহস্যজনক’ বলে মন্তব্য করেন উপজেলা চেয়ারম্যান বাবুল। তিনি বলেন, “একটি বিশেষ গোষ্ঠী অতি সুবিধা নিতে এটি চালু রেখেছে বলে আমার মনে হয়।
এরই মধ্যে নদী তীরবর্তী অনেক গ্রাম বিলীন হচ্ছে। অবৈধ যন্ত্রে বালু-পাথর উত্তোলনের কারণে সনাতন পদ্ধতিতে বালু উত্তোলনকারী সাধারণ শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। সোমবার (১৮ মার্চ) রাত ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জানা যায় যাদুকাটা নদীর পূর্বপাড় মনবেগ থেকে মিয়ারচর হয়ে লাউড়েরগড় সীমান্ত পর্যন্ত আবার পশ্চিমপাড় সোহালা গ্রাম থেকে পাটানপাড়া বাজার হয়ে বড়গোফটিলা পর্যন্ত প্রায় ৩শত ড্রেজার মেশিন চালিয়ে বালু পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। একদিকে ড্রেজার চালিয়ে নদী তীরবর্তী এলাকায় বিশাল বড় গর্ত করা হচ্ছে অন্যদিকে নদীর মাঝখানে চলছে শত শত সেইভ মেশিন চালিয়ে পাথর উত্তোলন কাজ। নদীপাড়ের লোকজন বলেন, অবাধে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু কাটার ফলে অনেক স্থান বিলীন হয়ে গেছে।
অনেক স্থান রয়েছে হুমকির মুখে। নদীর পশ্চিম পাড়ে আদর্শগ্রাম, জালরটেক, ইসকন মন্দির, গড়কাটি, ঘাগড়া, কোনাটছড়া, সোহালা, ফাজিলপুর, আনোয়ারপুর বাজার ও মাহতাবপুর গ্রাম ভাঙনের মুখে পড়েছে। এসব অপতৎপরতা বন্ধে প্রশাসনের কার্যত কোনো অভিযান নেই বললেই চলে। একাধিক ব্যবসায়ীরা বলেন, প্রতি ১২ ঘণ্টায় ড্রেজার চালানোর জন্য ১০ হাজার এবং সেইভ মেশিনের জন্য প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার টাকা দেওয়া হয় ‘প্রশাসনকে ম্যানেজ’ করার জন্য।
তবে এই অবৈধ কাজের বিরুদ্ধে এলাকার ব্যবসায়ী বা কোনো শ্রমিক প্রতিবাদ করলে তাকে আর নদীতে নামতে দেওয়া হয় না। তারা জানান, একটি ড্রেজার মেশিন দিয়ে দিনরাতে ২ হাজার ঘনফুট পাথর উত্তোলন করা যায়। ২৪ ঘণ্টা ড্রেজার চালানোর জন্য নদীর ইজারাদারদের ২০ হাজার করে টাকা দিতে হয়। দুই হাজার ঘনফুট পাথরের মধ্যে বোল্ডার (বড়) পাথর মেশিনে ভাঙিয়ে প্রতি ফুট ১১৫ টাকা ধরে বিক্রি করা হয়।
ভূতু (বোল্ডার থেকে ছোট) আর সিঙ্গেল পাথর প্রতিফুট প্রায় ১০০ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে বোল্ডার আর ভূতু পাথর আস্ত বিক্রি করা হয় না। এগুলো মেশিনে আগে ভাঙ্গা হয়, তারপর বিক্রি করা হচ্ছে। সেইভ মেশিনে উত্তোলন করা পাথরও একই দামে কেনাবেচা হয়। বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের দুইবারের চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন বলেন, “ রাতের বেলা প্রায় দুই তিনশো ড্রেজার ও সেইভ মেশিন চলছে। এসব চালানোর জন্য ইজারাদারদের নামে প্রতিদিন মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেট।
তিনি বলেন, “শক্তিশালী ড্রেজার মেশিন দিয়ে নদী তীরে ৩০ থেকে ৪০ ফুট গভীর গর্ত করছে। নদীর পাড়ে এমন হাজারো গর্ত করা হয়েছে। এবার বর্ষায় যখন পাহাড়ি ঢল আসবে তখন নদী তীরবর্তী হাজার-হাজার পরিবার ভিটেমাটি ও ফসলি জমি হারাবে। গত কিছুদিন আগে নদীর পাড় কাটা হয়েছিল অবাধে, পাড় কাটা বন্ধ থাকলেও চলছে ড্রেজারের তান্ডব।” বালু উত্তোলনের অনুমতি নিয়ে পাথর উত্তোলনের অভিযোগের বিষয়ে ইজারাদার রতন মিয়া সম্প্রতি বিভিন্ন ওয়েবপোর্টালে বলেন, “আমরা ইজারাদারা পাথর উত্তোলন করছি না।
পাথর উত্তোলন করছে এলাকাবাসী, তাদের বাধা দিলে তারা মানে না। এটি একটি সিন্ডিকেট করাচ্ছে। আমরা কিছুদিন আগে বাধা দিয়েছিলাম, তখন ঝামেলা হয়েছিল। এখন পাথর উত্তোলন নিয়ে কিছু বললে তাদের সঙ্গে মারামারি করতে হবে। যারা পাথর উত্তোলন করছেন তারা এসব পাথর গাড়ি দিয়ে সুনামগঞ্জে নিয়ে যাচ্ছেন, আমরা পাথর থেকে কোনো রয়্যালিটি নিচ্ছি না।” সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী ইতিপূর্বে সাংবাদিকদেরকে “ইজারার শর্ত ভেঙে কোনো কিছু করা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে” বলে আশ্বস্থ করলেও নদীতে ড্রেজার ও সেইভ মেশিন চালানো অব্যাহত রয়েছে।
ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে অভিযান পরিচালনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জেলা প্রশাসক ঘোষণা দিলেও রাতের বেলা বালি ও পাথর চুরির মহোৎসব ঠেকাতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন পুরোপুরি ব্যর্থ বলে দাবী করেন এলাকাবাসী। তারা বলেন,একাধিক মামলার আসামী চিহ্নিত চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী আফতাব উদ্দিনকে গ্রেফতার না করলে কোনক্রমেই বন্ধ হবেনা এসব অপকর্ম। গণদাবীর প্রেক্ষিতে অবিলম্বে আফতাব উদ্দিনকে গ্রেফতার করে ড্রেজার ও বোমা মেশিন দিয়ে বালু পাথর উত্তোলন বন্ধ এবং নদী তীরবর্তী জনপদ রক্ষার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কোনদিকে মোড় নেয় সেদিকে দৃষ্টি এখন সকলের।