আল-হেলাল,সুনামগঞ্জ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৪ , ২:০৯:৩৭ অনলাইন সংস্করণ
রনাঙ্গনে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করার দীর্ঘ ৫৩ বছর পর পৈত্রিক সম্পত্তি ফিরে পেয়ে খুশি হুইল চেয়ারে চলাচলকারী দেশের প্রধান ৩ জাতীয় বীরের অন্যতম এ গ্রেডভূক্ত যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম সামছুল ইসলাম।
শনিবার (২৭ জানুয়ারি) দুপুরে সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে তিনি ভ্রাম্যমান আদালতের রায়ের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন,আমি ৫৩ বছর একাধারে পঙ্গুত্ব ও পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে টেনশনের কারণে ঠিকমতো শান্তিতে ঘুমোতে পারিনি।
যে দেশকে ভালবেসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে সম্মুখ সমরে আহত হয়ে কলকাতায় ও দেশে আজীবন চিকিৎসাধীন থেকেছি সেই দেশে আমি ছিলাম পৈত্রিক সম্পত্তি হারা।
শুধু আমি একাই নই আমার ৪টি বোনও সম্পত্তির কানাকড়ি পাওয়াতো দূরের কথা ছটাক পরিমাণ ধান চাল পায়নি। যে ভাইটিকে বিশ্বাস করে সম্পত্তির তদারকীর দায়িত্ব দিয়েছিলাম সে এতদিন একা ভোগ করলেও কোন দু:খ ছিলনা।
শেষ পর্যন্ত আমার স্ত্রী ও বোনদের রেজিষ্ট্রি দলিলমূলে ক্রয়কৃত সম্পত্তি ছাড়াও আমাদের এজমালী সমস্ত সম্পত্তি নগদ টাকায় বন্ধক দিয়ে আমাদেরকে বঞ্চিত করে রেখেছিলো।
এ দু:খ যখন কোথায়ও বলার জায়গা ছিলনা তখনই জীবনের শেষ লড়াই এর অংশ হিসেবে ২৫ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী,অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এ কে এম আব্দুল্লাহ বীন রশিদ মহোদয়ের কাছে গেলে তারা তাৎক্ষনিকভাবে আমার সম্পত্তির বিষয়টি দেখে দেয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নির্দেশ দেন।
তৎপ্রেক্ষিতে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মফিজুর রহমান,তাৎক্ষনিকভাবে সলুকাবাদ ইউনিয়ন পরিষদে ভ্রাম্যমান আদালত ও গ্রাম আদালত বসিয়ে মাত্র ১ ঘন্টার ব্যবধানে সালিশ বিচার করে যে বিচার ফায়সালা দিয়েছেন তাতে আমি অসম্ভব খুশি হয়েছি।
আজ থেকে আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারবো। এখন আমার মনের বুঝা হালকা হয়েছে। আমি সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা প্রশাসনের এই সহযোগীতার কথা কৃতজ্ঞতার সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই অবহিত করবো।
যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম সামছুল ইসলামের চোখেমুখে কৃতজ্ঞতার ভাষা দেখে আবেগে আপ্লুত উপজেলা নির্বাহী অফিসার মফিজুর রহমান ও সলুকাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরে আলম সিদ্দিকী তপন দেশপ্রেমিক এই বীরসেনানীকে বুকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ ও কৃতজ্ঞতা ভাগাভাগি করলেন।
একপর্যায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে ফটোসেশন করলেন। অন্যদিকে আদালতের সিদ্বান্ত ঘোষণার আগেই অভিযুক্ত এস এম নুরুল ইসলাম কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে পা ধরে নি:শর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন বড় ভাই যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম সামছুল ইসলামের কাছে।
অকপটে স্বীকার করে বললেন,আমি প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে বড় ভাই ও ৪ বোনের এজমালী অর্থাৎ আমাদের সকলের সমস্ত সম্পত্তি বন্ধক দিয়েছি। সালিশ বিচারের রায়ে সিদ্বান্ত হয়, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম সামছুল ইসলামের স্ত্রী ফারজানা ইসলাম জুনুর গত ১২/৪/২০০০ইং তারিখে বিশ্বম্ভরপুর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের ৪৬৬ নং দলিলমূলে ক্রয়কৃত ১.২০ একর আমন রকম জমি এবং ৪ বোনের নামে ২০২৩ইং সনের ১৪ ফেব্রæয়ারি ২২৭ নং রেজিষ্ট্রি দলিলমূলে প্রদত্ত ৯৭ শতক জমির আদৌ কোন মালিকানা না থাকার পরও অবৈধভাবে বন্ধক দিয়ে এস এম নুরুল ইসলাম চরম অন্যায় ও ফৌজধারী অপরাধ করেছেন।
তাই মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী ও বোনদের দলিলকৃত জমির বন্ধকী টাকাপয়সা ফিরিয়ে দিয়ে আগামী ২৯ জানুয়ারি সোমবারের মধ্যে তাদের জমিজমার মালিকানা ও দখলদেহী যথারীতি এস এম নুরুল ইসলাম সমজিয়ে দিবেন। বাকী যেসব এজমালী সম্পত্তি তিনি টাকার বিনিময়ে এককভাবে বন্ধক দিয়েছেন সেগুলোর টাকা ফেরত দিয়ে ভাই বোনদের মধ্যে যার যার হিস্যা নিয়ম অনুযায়ী বন্টন করে দেবেন।
এজন্য সোমবার ২৯ জানুয়ারি বিশ্বম্ভরপুর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা শেখ মোঃ আক্কাছ আলীকে তাৎক্ষনিকভাবে দায়িত্ব প্রদান করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। এ সময় আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি সাংবাদিক আল হেলাল,সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাবের সদস্য হোসাইন মাহমুদ শাহীন, দৈনিক সংবাদ প্রতিদিন প্রতিনিধি রাজু আহমেদ রমজান,সলুকাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নং ওয়ার্ডের মেম্বার মোঃ মোতালেব মিয়া,চালবন গ্রামের সালিশী দ্বীন ইসলাম,হাশেম মিয়া,মিলন মিয়া,লামাপাড়া গ্রামের আব্দুল মান্নান,আবুল কাশেম,আব্দুল কদ্দুছ,ভাটিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মামুনুর রশীদ চৌধুরী,তাহিরপুর উপজেলার পাটানপাড়া নিবাসী মুহিত চৌধুরী,মুক্তিযোদ্ধার ভগ্নিপতি রুহীনূর কবীর ও জামাতা হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গরা উপস্থিত ছিলেন।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসের ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা শেখ মোঃ আক্কাছ আলী বলেন,স্থানীয় জগন্নাথপুর গ্রামের সার্ভেয়ার ফজলু মিয়াকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার জায়গা সঠিকভাবে পরিমাপ করত: সমজিয়ে দিতে আমি প্রস্তুত রয়েছি।
সোমবার সরজমিনে গিয়ে এই মহৎ কাজটি সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করতে সকলের সহযোগীতা কামনা করেছেন তিনি। উল্লেখ্য সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নের লামাপাড়া গ্রামের যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম সামছুল ইসলাম,স্থানীয় রণবিদ্যা মৌজার আর এস : জেএলনং ৩২,খতিয়ান নং ১৪৪৮,দাগ নং : ২০৪১,২০৮৭,২০৮৮,২০৯৭,২১০৪,২১২৩,২১২৬,২১৩৯,২৪০৫,২৪০৬, ২৪২৩,২৪২৪,২৪২৭,২৪৩০,২৪৩৩ এর ৬.৪৯ একর চারা,আমন,বাঁশঝাড়,বরুন্ডী ও বাড়ীরকম ভূমির যৌথ স্বত্তাধিকারী।
এছাড়া স্থানীয় জগন্নাথপুর বাজারটি তাঁর নামে নামকরণের জন্য বাজার কমিটি বাজারের কিছু জায়গা দলিলমূলে দান গ্রহন করলেও এই বাজারটি এখন পর্যন্ত তার নামে নামকরণ করা হয়নি। বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসার সম্মানজনকভাবে নিস্পত্তি করবেন বলেও প্রতিশ্রæতি ব্যক্ত করেন।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মফিজুর রহমান বলেন,একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে হুইল চেয়ারে চলাচল করছেন। মান্যবর রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতি বছরের রাষ্ট্রীয় দিনগুলিতে যাকে বঙ্গভবন ও গণভবনে নিয়ে সরকারী অনুষ্ঠানাদিতে সম্মান প্রদর্শন করেন তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যাগুলো অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়ে আমাদের দেখা উচিত বলে আমি মনে করেছি। তাই মাননীয় জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নির্দেশে এবং বিবেকের তাড়নায় ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অংশ হিসেবে তাৎক্ষনিকভাবে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদে বসে গ্রাম আদালত ও ভ্রাম্যমান আদালত একত্রে বসিয়ে তাঁর বিষয়টি সমাধান করেছি।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন,জেলা প্রশাসক মহোদয় দায়িত্ব প্রদান না করলে হয়তো আমি এ মহৎ কাজটি সম্পন্ন করার সুযোগ পেতামনা। যতক্ষণ পর্যন্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা তার ন্যায্য প্রাপ্য সমজিয়ে না পাবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর সেবায় বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা প্রশাসনের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলেও দৃঢ় প্রতিশ্রæতি ব্যক্ত করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। সলুকাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য নুরে আলম সিদ্দিকী তপন বলেন,আমাকে বিষয়টি জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য সৈয়দ তারিক হাসান দাউদ দেখার জন্য বলেছিলেন।
আমি বিষয়টি জানামাত্র ইউএনও মহোদয়কে শেয়ার করেছি। আজকে স্যারের নেতৃত্বে জাতির শ্রেষ্ট ও ত্যাগী সন্তানের বিষয়টি সমাধান করতে পেরে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে নিজেকে ধন্য মনে করছি।
তিনি বলেন,ঢাকার নবাবপুর রোডস্থ ৬৩ লালচান মকিমলেনের বাসিন্দা যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম সামছুল ইসলাম শুধু আমার নানা শ্বশুড়ই নন তিনি আমার ইউনিয়ন তথা সারা দেশের গৌরব ও অহংকারের অন্যতম পাত্র।
শহরের বুলচান্দ উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির ছাত্র থাকাবস্থায় ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে আহত হয়ে এখনও চিকিৎসাধীন এবং পঙ্গুত্বকে বরন করে চলেছেন তিনি। দেশের জন্য এরকম আত্মত্যাগ কয়জনের ভাগ্যে জুটে।