স্টাফ রিপোর্টার; ৩০ অক্টোবর ২০২৩ , ৪:১৩:৩৯ অনলাইন সংস্করণ
দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা, সংঘাত, সংঘর্ষ, গুলি ও পুলিশের গাড়িসহ যানবাহনে অগ্নিসংযোগের মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল।
রোববার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা এই হরতালে কোথাও কোথাও সড়ক অবরোধ হয়েছে। হরতাল সমর্থক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা, প্রতিরোধ ও পালটা হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে চারজনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। গ্রেফতার করা হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক অবস্থানের মধ্যেও রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা কয়েকটি দল ও জোটও পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করেছে। এদিনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সড়কে ছিল চরম গণপরিবহণ সংকট। ব্যক্তিগত গাড়ি এড়িয়ে চলেছেন অনেকে। এতে চিরচেনা যানজটের শহর ঢাকা ছিল অনেকটাই ফাঁকা। বন্ধ ছিল কিছু কিছু এলাকার দোকানপাট। চরম ভোগান্তিতে পড়েন অফিসগামী মানুষ।
যুগান্তরের ব্যুরো, জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে- নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, গাইবান্ধা, লক্ষ্মীপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় ১৩ পুলিশসহ বিএনপির ৭০ নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে পুলিশের সঙ্গে হরতাল সমর্থকদের সংঘর্ষে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় বিএনপির অর্ধশত নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধসহ আহত হন। বগুড়ায় ইউএনওর গাড়িতে হামলাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে এক কিশোর গুলিবিদ্ধসহ ১২ জন আহত হয়েছেন। একই জেলায় আওয়ামী লীগের সঙ্গেও বিএনপির সংঘর্ষ হয়েছে। কিশোরগঞ্জের ইটনায় ইউএনওর গাড়ি ভাঙচুরকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া রাজশাহী, নোয়াখালী, খুলনা, মানিকগঞ্জ, গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশের গাড়িসহ অন্তত ৩৫টি গাড়িতে আগুন ও ভাঙচুর চালিয়েছে।
শনিবার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে কাকরাইল, নয়াপল্টন, বিজয়নগর, ফকিরাপুলসহ আশপাশের এলাকায় তুমুল সংঘর্ষ হয়। মহাসমাবেশে হামলার অভিযোগ করে রোববার দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকে বিএনপি। আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ৩ বছর ৮ মাস পর আবেদন হারানো কর্মসূচি হরতাল নিয়ে সবার মধ্যেই ছিল কৌত‚হল। পাশাপাশি ছিল ভয়, শঙ্কা ও আতঙ্ক। ফলে হরতালে দেশজুড়ে তৎপর ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা সতর্ক প্রহরায় ছিলেন। র্যাব রাজধানীতে ৮৭টি টহলসহ সারা দেশে ২৪৬টি টহল কার্যক্রম পরিচালনা করে। রাজধানীতে মোতায়েন ছিল ১২ প্লাটুন বিজিবি। প্রতি প্লাটুনে ২০-৩০ জন করে সদস্য ছিলেন। হরতালে সচিবালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘিরে ছিল বাড়তি নিরাপত্তা। এর আগে শনিবার ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ঘোষণা দেন, হরতালের নামে নৈরাজ্য করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে বিএনপির হরতাল কর্মসূচির দিন দেশজুড়ে শান্তি সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে মাঠে ছিল আওয়ামী লীগ। হরতাল প্রতিহত করারও ঘোষণাও দেয় দলটি। এরই অংশ হিসাবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মোড়ে মোড়ে ছিল ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক অবস্থান। এ অবস্থায় বিএনপির নেতাকর্মীরা রাজপথে নেমে অনেক জায়গায় হামলা ও প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছেন। রাজধানীতে বাসে আগুন দিয়ে পালানোর পথে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ধাওয়ায় মৃত্যু হয় এক বিএনপি নেতার। কিন্তু বিএনপির অভিযোগ- তাকে ভবনের ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। লালমনিরহাটে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন শ্রমিক লীগের এক নেতা। বাড়িতে পুলিশের তল্লাশির সময় ফরিদপুরের নগরকান্দায় বিএনপি নেতার স্ত্রী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। রাজধানীর ডেমরায় দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে বাসে ঘুমন্ত অবস্থায় নিহত হয়েছেন এক চালকের সহকারী (হেলপার)।
এদিকে হরতাল উপেক্ষা করে গাড়ি চলাচল অব্যাহত রাখায় মালিক-শ্রমিকদের আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছেন ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সমিতির দপ্তর সম্পাদক জানান, হরতালে ৭টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করে সংগঠনটি।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, শনিবার দুপুর ১টা থেকে রোববার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঢাকায় ২৭টিসহ সারা দেশে ৪৫টি আগুন দেওয়ার খবর পেয়েছেন তারা। এরমধ্যে ৪১টি ঢাকা বিভাগে, ১টি রাজশাহী বিভাগ, ২টি খুলনা বিভাগে, ১টি রংপুর বিভাগে। এসব অগ্নিকাণ্ডে ১৯টি বাস, ৩টি মাইক্রোবাস, ৩টি অ্যাম্বুলেন্স, ১টি ট্রাক, ৭টি মোটরসাইকেল, ৩টি পিকআপ, ১টি সিএনজি পুড়ে যায়। এছাড়া পুলিশ বক্স, বিদ্যুৎ অফিস, বাস কাউন্টার, রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে আগুনের ঘটনা ঘটে। রোববার সকাল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সারা দেশে মোট ১৩টি আগুনের সংবাদ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৪টি ঢাকা মহানগর এলাকায় ঘটে।
রোববার সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ সড়কই ফাঁকা। প্রতিটি মোড়ে মোড়ে পুলিশের সতর্কাবস্থান রয়েছে। লাঠিসোঁটা নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় শোডাউন দিয়েছে আওয়ামী লীর নেতাকর্মীরা। বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা ঝটিকা মিছিল করে দ্রুত সময়ের মধ্যেই এলাকা থেকে সটকে পড়েছেন। এই সময়ের মধ্যে সামনে কোনো গাড়ি পেলে ভাঙচুর করেছেন অনেকে। যানবাহন কম থাকায় সাধারণ মানুষ চরম হয়রানির শিকার হয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজে বের হওয়া অনেক নাগরিককে হেঁটে কিংবা রিকশায় গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়েছে। যানবাহন সংকটের কারণে রাস্তায় চলাচল করা সীমিত সংখ্যক যানবাহনকে অতিরিক্ত ভাড়া হাঁকতে দেখা গেছে। এই হরতালে সবেচেয় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শ্রমজীবী মানুষ।
নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয় : বিএনপির ডাকা হরতালে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীদের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। মূল ফটকের সামনের অংশটি হলুদ ফিতা দিয়ে ক্রাইম সিন লিখে বেষ্টনি দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। কার্যালয়ের মূল ফটকে তালা ঝুলতে দেখা গেছে। কার্যালয়ের সামনে সতর্ক অবস্থায় ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সকাল ১০টার দিকে কার্যালয়ের সামনে থেকে আলামত সংগ্রহ করছেন সিআইডির সদস্যরা।
পুলিশের মতিঝিল জোনের সহকারী কমিশনার গোলাম রুহানি যুগান্তরকে বলেন, যে অংশটি বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে, সেখান থেকে ককটেল সরবরাহ করা হয়েছিল। তাই এটিকে ‘ক্রাইম সিন’ ঘোষণা করা হয়েছে।
রাজধানীর অন্যান্য স্থান : হরতালের সমর্থনে রোববার সকালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ভুইগড় থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব দেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম, সহ-অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সুমন, দিনাজপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদ কচি, নারায়ণগঞ্জ জেলা যুবদলের সদস্যসচিব মশিউর রহমান রনি, নারায়ণগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব সালাউদ্দিন সালু, নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের রহমান জিকু প্রমুখ। এ সময় নেতাকর্মীরা সেখানে টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। এর আগে শান্তিনগর মোড় থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে আশপাশের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করেন।
দুপুরে ঢাকা নর্দা থেকে গুলশান লিংক রোড পর্যন্ত হরতালের সমর্থনে আরেকটি বিক্ষোভ করে নেতাকর্মীরা। এ মিছিলেও নেতৃত্ব দেন রুহুল কবির রিজভী। আরও অংশ নেন স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম, সহ-অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সুমন, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টন প্রমুখ। এসময় রিজভী বলেন, অন্যায়ভাবে বিএনপির শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ পণ্ড, পুলিশ হত্যা সরকারের নীলনকশার অংশ। টুকু বলেন, এই সরকারের পতনের মধ্যে দিয়ে যুবদল নেতা শামীম মোল্লাসহ সব নেতাকর্মীদের গুম, খুনের বিচার এই বাংলার মাটিতেই হবে।
সকালে মহাখালীতে বিক্ষোভ মিছিল করে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির নেতাকর্মীরা। এতে নেতৃত্ব দেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার। হরতালের সমর্থনে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বিক্ষোভ করে বিএনপি নেতাকর্মীরা। হরতালের সমর্থনে রামপুরা আবুল হোটেলের সামনে থেকে মিছিল বের করে কৃষক দল। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিন ও সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুলসহ নেতাকর্মীরা। ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা মগবাজার রেলগেট অবরোধ করা হয়। ১২টার সময় মগবাজার মোড় থেকে রেলগেট পর্যন্ত অবরোধ রেখে বিক্ষোভ করে।
উত্তরায় ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের আহ্বায়ক শরিফ উদ্দিন জুয়েলের নেতৃত্বে হরতালের সমর্থনে মিছিল করে। সকালে দৈনিক বাংলা মোড়ে বিক্ষোভ মিছিল করে যুবদল ঢাকা মহানগর দক্ষিণ। মিছিলের নেতৃত্ব দেন যুবদল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ১নং সহ-সভাপতি নুরুল ইসলাম নয়ন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক খন্দকার এনামুল হক এনাম ও সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়ন। আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এমএ গাফফার এবং মতিঝিল, সবুজবাগ, খিলগাঁও, শাজাহানপুর, পল্টন শাহবাগ, রমনা থানা যুবদলের নেতারা। মিছিলটি দৈনিক বাংলা মোড় থেকে শুরু হয়ে ফকিরাপুল মোর ঘুরে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ করা হয়। স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসানের নেতৃত্বে শান্তিনগর পপুলার থেকে ইস্টার্ন প্লাস পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল করে সংগঠনটির নেতারা।
বাড্ডা, ভাটারা ও রামপুরা থানা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের উদ্যোগে বাড্ডা এলাকার মিছিল ও সমাবেশ করে। এতে ঢাকা মহনগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এজিএম শামসুল হকসহ নেতাকর্মীরা অংশ নেন। হরতালের সমর্থনে মহাখালী এলাকায় মিছিল ও রাস্তা অবরোধে সরকারি তিতুমীর কলেজ ছাত্রদল। পুরান ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের বিক্ষোভ মিছিল হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে এ বিক্ষোভ মিছিল হয়। এছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন থানায় বিক্ষোভ মিছিল করে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
গণতন্ত্র মঞ্চসহ সমমনাদের বিক্ষোভ : হরতালের সমর্থনে রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল করে গণতন্ত্র মঞ্চসহ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোট। দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবসংলগ্ন এলাকা থেকে মিছিলটি বিজয়নগরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পুরানা পল্টন মোড়ে শেষ হয়। সরকার বিভিন্ন এজেন্ট দিয়ে উসকানিমূলক কাজ করিয়ে বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে সহিংসতার চেহারা দিয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তার অভিযোগ, এই সহিংসতার অজুহাতে এখন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির অন্য নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে। এ সময় জোটের থাকা শরিকদের শীর্ষ নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।
হরতালের সমর্থনে বিজয়নগরে মিছিল করে ১২ দলীয় জোট, রামপুরায় মিছিল করে নুরুল হক নুর নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ। এছাড়াও মিছিল করে লেবার পার্টিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
জামায়াতে ইসলামীর বিক্ষোভ মিছিল : হরতালের সমর্থনে রোববার রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির নেতাকর্মীরা মিরপুর, উত্তরা, তুরাগ, মোহাম্মদপুর, পলবী, বনানী, বিমানবন্দর, ভাটারা, গুলশানসহ আরও কয়েকটি থানায় মিছিল ও পিকেটিং করে।
লালমনিরহাট : বেলা ১১টায় সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগরে বিএনপি হরতালের সমর্থনে ও আওয়ামী লীগ শান্তি মিছিল বের করে। এ সময় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ঢিল ছোড়াছুড়ির একপর্যায়ে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষে জাহাঙ্গীর হোসেনসহ তিনজন লাঠি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মারাত্মক আহত হন। তাদের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জাহাঙ্গীর মারা যান। নিহত জাহাঙ্গীর (৫০) লালমনিরহাটের গোকুন্ডা ইউনিয়নের বেড়পাঙ্গা এলাকার আজিজার রহমানের ছেলে। তিনি সদর উপজেলার গোকুন্ডা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য ও সদর উপজেলার লোড-আনলোড শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন।
ফরিদপুর : নগরকান্দায় বিএনপি নেতা এসএম ইকরাম হোসেনের বাড়িতে শনিবার রাতে তল্লাশি চালায় পুলিশ। এ সময় ওই নেতা বাড়িতে ছিলেন না। তল্লাশির সময় আতঙ্কে তার স্ত্রী রেঞ্জুয়ারা বেগম (৪০) হৃদরোগে মারা গেছেন। শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে নগরকান্দা উপজেলার চরযশোরদী ইউনিয়নের দহিসারা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। ইকরাম হোসেন ভাঙ্গা উপজেলার কালামৃধা ইউনিয়নের দেওড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির পলি উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক। রেঞ্জুয়ারা বেগম স্থানীয় চাঁদহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। নগরকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিরাজ হোসেন বলেন, তল্লাশির সময় আতঙ্ক সৃষ্টি হতে পারে- এ জাতীয় কোনো ঘটনা পুলিশ ঘটায়নি।
বগুড়া : বেলা সাড়ে ৯টার দিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীরা গালাপট্টি সড়কে সংঘর্ষে জড়ায়। এ সময় ধাওয়া-পালটাধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন ভবনের উপর থেকে পিকেটাররা ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। পরে পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আল রাজি জুয়েলসহ ৭-৮ জন আহত হন। বাঘাপাড়া খোলারঘর এলাকায় পিকেটাররা ইটপাটকেলের আঘাতে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফিরোজা পারভীনের গাড়ির কাঁচ ভেঙে দেয়। অল্পের জন্য তিনি রক্ষা পান। সেখানে পিকেটাররা মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে। তারা নির্বিচারে হামলা চালিয়ে অন্তত ১৭টি গাড়ি ভাঙচুর করেছে। এ সময় পুলিশের রাবার বুলেটের আঘাতে মাহী (১৪) নামে এক কিশোর আহত হয়। তাকে রফাতউল্লাহ কমিউনিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ছাড়া হামলা-সংঘর্ষে তিন পুলিশ ও সাংবাদিকসহ অন্তত ১২ জন আহত হয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জ, আড়াইহাজার ও রূপগঞ্জ : আড়াইহাজারে মিছিলে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বান্টি বাজার থেকে পাচরুখী এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এতে প্রায় ১ ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে। সংঘর্ষে বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সহসম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ ও জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মাশুকুল ইসলাম রাজীবসহ ৫০ নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন। অপর দিকে হরতালের সমর্থনে নারায়ণগঞ্জ শহরের পৃথক স্থানে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। সকালে নগরীর মিশনপাড়া এলাকায় শিবিরের কর্মীরা দুটি বাস ভাঙচুর করে একটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এদিকে রূপগঞ্জে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এক ব্যবসায়ীর মোটরসাইকেলে আগুন দিয়েছে হরতাল সমর্থকরা।
গাজীপুর, টঙ্গী পূর্ব ও শ্রীপুর : নগরীর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল ও পিকেটিং করেছে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সকাল সাড়ে ১০টায় টঙ্গীর চেরাগ আলী মার্কেটের সামনে ঢাকাগামী বিআরটিসি’র দোতলা একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। শ্রীপুরে হরতাল সমর্থকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে দুটি বাস ভাঙচুর করে। এছাড়া হরতালের আগের রাতে মহানগরীর ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের কোনাবাড়িতে আজমেরী পরিবহণের একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ : পুরান থানার রেললাইন এলাকাসহ শহরের বিভিন্ন সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে পিকেটিং করে বিএনপির নেতাকমীরা। এ সময় শোলাকিয়া ঈদগাহ এলাকায় ইটনা ইউএনওর গাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। এতে হরতাল সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ১৪টি ফাঁকা গুলি ও দুটি টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এ ঘটনায় ১০ পুলিশ আহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে।
রাজশাহী ও বাঘা : সকাল থেকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে অবস্থান নেয়। বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের তেমন দেখা যায়নি। মহানগরজুড়ে কঠোর অবস্থানে ছিল পুলিশ। সড়কে গাড়ির সংখ্যা ছিল কম। দোকানপাটও কম খোলে। বেলা পৌনে ১২টায় বাঘা উপজেলার মনিগ্রাম ইউনিয়নের আটঘরিয়া এলাকায় পুলিশ সার্জনের একটি প্রাইভেট কারে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।
নোয়াখালী ও বেগমগঞ্জ : জেলার সোনাপুর বাসস্টেশন থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। ৯ উপজেলার অভ্যন্তরীণ রুটেও যানবাহন চলাচল করেনি। সোনাইমুড়ী উপজেলার একটি সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে হরতাল সমর্থকরা। মাইজদীর শহিদ ভুলু স্টেডিয়ামের সামনের সড়কে ঝটিকা মিছিল করে। শনিবার রাতে সেনবাগ উপজেলার সেবারহাট বাজারে একটি ট্রাকে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। বেগমগঞ্জে দুটি সিএনজি ভাঙচুর করে।
খুলনা : দুপুর ১২টার দিকে নগরীর খালিশপুরে বিএনপির কার্যালয়ে কে বা কারা আগুন দেয়। এতে কার্যালয়ের টেবিল-চেয়ারসহ সব আসবাবপত্র পুড়ে যায়। এই কার্যালয়টির বিপরীতে রাস্তার পশ্চিম পাশে আওয়ামী লীগের কার্যালয়। প্রত্যক্ষদর্শী আনোয়ার হোসেন বলেন, ৫০-৬০ জনের একটি দল জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে মোটরসাইকেলে এসে আগুন দেয়। এ সময় তারা আশপাশের বেশ কয়েকটি দোকানে ভাঙচুর চালায়।
সিলেট : সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে পিকেটিং করে বিএনপি, অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা। এসময় পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পালটাধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং পুলিশের পক্ষ থেকে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছোড়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
মানিকগঞ্জ : ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের তরা এলাকায় স্বপ্ন পরিবহণের বাসে যাত্রী বেসে উঠে যাত্রীদের নামিয়ে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। পরে মোটরসাইকেলে তারা পালিয়ে যায়। এর আগে শনিবার গভীর রাতে মানরা এলাকায় একটি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়া হয়েছে।
গাইবান্ধা : গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ সময় পুলিশকে মারধর করে আটক তিন বিএনপি নেতাকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।
গজারিয়া (মুন্সীগঞ্জ) : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া অংশের বক্তারকান্দি এলাকায় হরতাল সমর্থকদের দেওয়া আগুনে পুড়ে গেছে একটি মিনিবাস। এ সময় বাসের এক যাত্রী আহত হয়েছেন।
কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) : দুপুরে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ঘাটার চরে স্বাধীন পরিবহণ নামে একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এর আগে শনিবার রাতে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুর এলাকায় একটি লেগুনায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
লক্ষ্মীপুর : রামগতিতে পুলিশের সঙ্গে পিকেটারদের সংঘর্ষে দুই পুলিশ আহত হয়েছেন। সকালে উপজেলার পোড়াগাছা ইউনিয়ন আজাদনগর ব্রিজ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এসময় একজনকে আটক করা হয়।
ঠাকুরগাঁও : শহরের কালীবাড়ি এলাকায় বেলা ১টার দিকে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পালটাধাওয়া হয়েছে। এ সময় একজনকে আটক করে পুলিশ।
কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) : বরমচাল-ছকাপন এলাকায় শনিবার রাত ১০টায় ঢাকা-সিলেট রেললাইনে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। আগুন দেখতে পেয়ে চালক ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের সহায়তায় আগুন নেভায়। পরে ট্রেনটি গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায়।