প্রতিনিধি ২৪ মে ২০২৩ , ৫:৩২:৩৫ অনলাইন সংস্করণ
ভাটি বাংলা ডেস্কঃ সুনামগঞ্জের সোনার মানুষ মুহাম্মদ আবদুল হাই”। আজ ২৩ মে এই মহান মানুষটির জন্মদিন। ভাটির জনপদের সাহিত্য সাংবাদিকতা সংস্কৃতি ও জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখা প্রশাখায় বিচরনকারী মানুষেরা আজও যার স্পর্শ ও আদর্শ অনুভব করেন সেই কাঙ্কিত ভালোবাসার মন মানুষের নাম মুহাম্মদ আবদুল হাই চৌধুরী গোলাপ মিয়া যিনি নিজেকে হাছন পছন্দ নামে অভিহিত করেছিলেন বিজ্ঞ আদালতে হলফনামা প্রদান করার মাধ্যমে।
দার্শনিক এরিষ্টটল এর ন্যায় প্রতিভাবান আবদুল হাই ছিলেন কবি সাংবাদিক সাহিত্যিক শিক্ষক নাট্যকার গীতিকার সুরকার শিল্পী জননেতা অভিনেতা ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধাসহ বহুগুনে গুনান্বিত একজন মডেল ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৯২৯ সালের ২৩শে মে সুনামগঞ্জ পৌরসভার আরপিন নগর এর বিখ্যাত তালুকদার পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। হযরত শাহ আরেফিন (রহঃ) এর স্মৃতিধন্য বিজড়িত আরপিন নগরের সম্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া এই মহান সাধক মানুষটি তার ব্যক্তি জীবনের সারাটি মুহুর্ত ব্যয় করেছেন মানুষের জন্য। মা মাটি ও মরমী সংস্কৃতির শেকড়ের সন্ধানে আজীবন সাধনা করে কালের ইতিহাসে তিনি কিংবদন্তি হয়ে আছেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুস সামাদ তালুকদার মাতা মুর্শিদা খাতুন চৌধুরানী। ৬ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মা বাবার পঞ্চম সন্তান। মোঃ আব্দুল হাই চৌধুরী ছিল তার আসল নাম। পরিবারের সবাই আদর করে তাঁকে গোলাপ মিয়া বলে ডাকতেন। তাঁর অপর ৫ ভাই বোনেরা হচ্ছেন জনাবা কমরুন্নেছা খানম চৌধুরী কনা বিবি স্বামী মছদ্দর আলী গ্রাম কুতুবপুর ইউনিয়ন গৌরারং উপজেলা সুনামগঞ্জ,দ্বিতীয় সৈয়দুন্নেছা খানম চৌধুরী সৈয়দ বিবি স্বামী গোলাম রসুল চৌধুরী গ্রাম মধুরাপুর উপজেলা দিরাই,তৃতীয় ভ্রাতা মুহাম্মদ আব্দুল আহাদ চৌধুরী তারা মিয়া,চতুর্থ সহিফা খানম চৌধুরী স্বামী সমরু মিয়া বাসা ৪ জামান হাউজ উকিলপাড়া আ/এ সুনামগঞ্জ,ষষ্ঠ ও কনিষ্ট ভ্রাতা হচ্ছেন আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী লাট মিয়া। মুহাম্মদ আবদুল হাই মাত্র ১১ বছর বয়সে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় সমগ্র আসামে মেধা তালিকায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে সুনামগঞ্জের গৌরব বর্ধন করেন। ১৯৪৭ইং সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে রেফারেন্ডাম আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। ১৯৪৮ সালে সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১ম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে সিলেট এমসি কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালের ১৬ই নভেম্বর গঠিত অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে যোগ দেন যুবলীগে। ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২২/২/১৯৫২ইং বিকালে স্থানীয় এইচ এমপি স্কুলের বারান্দায় এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করত ঐ ছাত্রনেতাকে আহবায়ক করে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ সুনামগঞ্জ মহকুমা কমিটি গঠন করা হয়। ২৬/২/১৯৫২ইং টাউনহল মার্কেটের সম্মুখে বিশাল ছাত্র ও জনসমাবেশের মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন হয় স্থানীয় ভাষা আন্দোলন। সাংস্কৃতিক সংগঠক আবদুল হাই ১৯৫৩ইং সনে সুনামগঞ্জের উদীয়মান নাট্যশিল্পীদের নিয়ে গঠন করেন শিল্পী সংসদ। বিএ পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহনকালে দেশে ১৯২ (ক) ধারা জারী হলে তিনি গ্রেফতার হয়ে কারাবরন করেন। তিনি ১৯৫৫ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ডিস্টিংশন সহ বি.এ পাশ করেন। ১৯৫৬ সালে গঠিত মহকুমা আওয়ামীলীগের প্রথম কার্যকরী কমিটির সাধারন সম্পাদক এবং ২য় কার্যকরী কমিটির সভাপতিসহ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি আওয়ামীলীগ রাজনীতির সাথেই যুক্ত ছিলেন। আইয়ুব খানের জারীকৃত সামরিক শাসনের ফলে রাজনীতি নিষিদ্ধ হবার পর বসে না থেকে গ্রাম বাংলায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার মহান ব্রত নিয়ে বর্তমান দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার প্রাচীন বিদ্যাপীঠ জয়কলস উজানীগাঁও রশিদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে মহান পেশা শিক্ষকতায় যোগ দেন। সুনামগঞ্জ কলেজের বাংলা প্রভাষক ছাড়াও সর্বশেষ এইচ.এম.পি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হন। ১৯৬৬ র ৬ দফা আন্দোলন,৬৯ এর গণ অভ্যত্থান ও ৭০ এর সাধারন নির্বাচনসহ সবকটি গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। মহকুমা রিলিফ কমিটির সেক্রেটারী হিসেবে লঙ্গরখানা চালুক্রমে দুস্থ মানুষের পাশে খাদ্য বিতরনের কাজ পরিচালনা করেন। মহকুমা আর্টস কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী ও পাবলিক লাইব্রেরীর (বর্তমানে শহীদ জগৎজ্যোতি পাঠাগার) সহকারী সেক্রেটারী ছাড়াও ১৯৬৬ সালের জুন মাসে স্থানীয় লেখক ও সাহিত্যানুরাগীদের নিয়ে তিনি সর্বপ্রথম আল ফারুক প্রেস ট্রাস্ট ও সুনামগঞ্জ সাহিত্য মজলিশ গঠন করেন। “হাছন রাজার গান কি কি ছিল কি হয়েছে এবং কি হওয়া উচিত”প্রবন্ধের মাধ্যমে বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে হাছনগীতিকে উপস্থাপন করেছেন স্বগৌরবে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে তিনি অন্যতম অভিনেতা যিনি সর্বপ্রথম সুনামগঞ্জের মাটিতে সিরাজউদ্দৌলা নাটকে কেন্দ্রীয় নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৬৬ ইং সনে প্রান্তিক নাট্য সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টার পদ অলংকৃত করেন। প্রগতিশীল নেতাকর্মী সমর্থকদের নিয়ে গড়ে তুলেন স্বেচ্ছাসেবী অরাজনৈতিক সমাজ উন্নয়ন সংস্থা সোভিয়েট বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি। তার সুদক্ষ নেতৃত্ব ও সার্বিক ব্যবস্থাপনাতেই ১৯৬৪ সালের ১৮ ফেব্রæয়ারি সুনামগঞ্জে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন দলমতের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে বৃহত্তর পরিসরে সাংস্কৃতিক সমাবেশের আয়োজন এর একক কৃতিত্বের দাবীদার স্বয়ং তিনি নিজে। তাঁর ব্যক্তি মালিকানাধীন মুর্শেদী প্রেস সুনামগঞ্জের রাজনীতি সংস্কৃতি ও সামাজিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। আওয়ামীলীগ এর উত্থান,৭০ এর নির্বাচন পরিচালনা,সকল স্থানীয় জাতীয় আন্দোলন এর কৌশল নীতি নির্ধারনসহ নানা দলমতের মানুষের আশ্রয়স্থল ছিল এটি। আবদুল হাই সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে ১৯৫৬ সালের ১৪ আগষ্ট সাপ্তাহিক দেশের দাবী,১৯৬২ সালে সাপ্তাহিক সুরমা,১৯৭২সালে অর্ধ সাপ্তাহিক দেশের কথা ও ১৯৭৩ সালে সাপ্তাহিক সুর্যের দেশ পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ মুক্তি সংগ্রামের সর্বাত্বক আহবান জানিয়ে প্রকাশ করেন “জনমত ”নামে একটি বুলেটিন। তাঁর স্বরচিত গীতিগ্রন্থ উতলা বাতাসে ও উত্তাল তরঙ্গ। “ গনি সঙ্গীত, ভাইরে রাধারমণ বলে” নামে গানের বই, “উদাস হাছন রাজার কথা” নামে কাব্যসংগীত এবং “দর্শনের দর্শন ”নামে রম্য রচনাসহ সর্বশেষ ৫টি বই প্রকাশিত হয়। তিনিই সর্বপ্রথম স্থানীয় সাংবাদিকদের একমাত্র সংগঠন সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাবের গোড়াপত্তন করেন। জেলা সাংবাদিক সমিতিরও প্রতিষ্টাতা সভাপতি ছিলেন। ১৯৭১ সালে ৫নং সেক্টরের অধিনস্থ বালাট সাবসেক্টরের তথ্য ও প্রচার দপ্তরের মূল দায়িত্বও পালন করেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন অভিযানের খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও আকাশ বাণী থেকে তাঁর প্রচেষ্ঠাতেই প্রচারিত হয় নিয়মিত। ১৯৭৩ইং সালের ১৭ ফেব্রয়ারি শনিবার সকাল ১০ ঘটিকায় সুনামগঞ্জ স্টেডিয়ামে সাবেক মন্ত্রী অক্ষয় কুমার দাশ সভাপতি ও মুহাম্মদ আবদুল হাই (হাছন পছন্দ) সাধারন সম্পাদক এর নেতৃত্বাধীন মহকুমা আওয়ামীলীগের অভ্যর্থনা সমিতি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে সুনামগঞ্জের ছাত্রজনতার পক্ষ থেকে এক বিশাল গণ সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। ১৯৮৩ সালের ২৫ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরন করেন। আব্দুল হাই সম্পর্কে বীর মুক্তিযোদ্ধা এস.এন.এন এম মাহমুদুর রসুল বলেন,জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব সুনামগঞ্জে ৮বার শুভাগমন করেন। ১৯৫৬ সালের ২৬ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দুর্নীতি দমন মন্ত্রী থাকাবস্থায় সুনামগঞ্জে সর্বপ্রথম এসে মহকুমা আওয়ামীলীগের যে কমিটি গঠন করেন ঐ কমিটির সাধারন সম্পাদক ছিলেন আবদুল হাই। ১৯৬৪ সালের ৩০ আগস্ট জনাব তাজ উদ্দিন আহমদ ও মুহাম্মদুল্লাহ সাহেব সহকারে বঙ্গবন্ধুর সুনামগঞ্জ সফরের ২য় সভাটিতে সভাপতিত্ব করেছেন তিনি। ১৯৭৩ইং সালের ১৭ ফেব্রæয়ারি রোজ শনিবার প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সংবর্ধনা মঞ্চের সঞ্চালকের দায়িত্বও তিনিই পালন করেন। এইভাবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি সভামঞ্চে একজন তুখোড় বক্তা হিসেবে তিনি বক্তব্যও রেখেছেন। ৯৪ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মরহুম মুহাম্মদ আবদুল হাই এর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছেন তাঁর দৌহিত্র সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি সাংবাদিক বাউল আল-হেলাল।