প্রতিনিধি ১৩ মে ২০২৩ , ৩:৪৮:৫৭ অনলাইন সংস্করণ
‘অত্যধিক প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে’ পরিণত হয়েছে ‘মোখা’। দেশের সমুদ্র বন্দরগুলোকে আট নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতরের ১২ নম্বর বিশেষ আবহাওয়া বুলেটিনে একথা জানানো হয়েছে। আগামীকাল রোববার দুপুর নাগাদ। মোখা কক্সবাজার ও মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হানতে পারে। বর্তমানে ‘মোখা’ পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও এর কাছাকাছি এলাকা থেকে উত্তর, উত্তর-পূর্ব দিকে গতি বজায় রেখে ধেয়ে আসছে। এটি একই দিকে অগ্রসর ও আরো ঘনীভূত হচ্ছে। তবে আঘাতের পূর্ববর্তী যে কোন সময় পর্যন্ত ‘মোখা’ তার গতিপথ পরিবর্তন অর্থাৎ অন্য কোন দিকে মোড় নিতে পারে। শক্তি হ্রাস-বৃদ্ধি পেতে পারে। এ নিয়ে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জনমনে ভয় ও শঙ্কা অব্যাহত রয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যায় ভারতের আবহাওয়া বিভাগের (আইএমডি) দিল্লি দফতরের আবহাওয়া ও ঘূর্ণিঝড় বিজ্ঞানী ড. আনন্দ কুমার দাশ সর্বশেষ পূর্বাভাস প্রতিবেদনে জানান, পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ উত্তর, উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর এবং আরো ঘনীভূত ও শক্তিশালী হয়ে গতকাল রাতে শেষ তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ীÑ ‘অত্যধিক প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে’ রূপ নিচ্ছিল।
আজ শনিবার সারাদিন বঙ্গোপসাগরে অবস্থানকালে ‘অত্যধিক প্রবল মোখা’র সর্বোচ্চ গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৭০ থেকে ১৮০ কি.মি. এবং আরও বেড়ে গিয়ে ১৮০ থেকে ১৯০ কি.মি. পর্যন্ত। যা দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২শ’ থেকে ২১০ কি.মি. পর্যন্ত উঠতে পারে। অবশ্য বিজ্ঞানী ড. আনন্দ কুমার এটাও জানান, ‘মোখা’ আগামীকাল রোবরার উপকূলে আঘাতের সময়ে শক্তি কিছুটা কমতে পারে। তখন এটি ‘অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়’ হতে পারে। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র সর্বোচ্চ গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৫০ থেকে ১৬০ কি.মি.। যা দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৭৫ কি.মি. পর্যন্ত উঠতে পারে। তবে ‘মোখা’ আঘাতের আগে গতি ও শক্তি হতে পারে কম কিংবা বেশি।
‘মোখা’র সক্রিয় প্রভাবে বঙ্গোপসাগর উত্তাল রয়েছে। উপকূলজুড়ে বিরাজ করছে গুমোট আবহাওয়া। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরে ৪ নম্বর স্থানীয় হুশিয়ারি সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ পরিস্থিতিতে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সঙ্কেতের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ‘অ্যালার্ট-২’ জারি করেছে। সে অনুযায়ী বন্দর ও জাহাজের স্থাপনাসমূহের নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও সতর্কতা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এদিকে ‘মোখা’র প্রভাবে গতকাল তাপমাত্রা আরও কিছুটা কমেছে। বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। অস্বস্তি কিছুটা হলেও কেটে যাচ্ছে। ‘মোখা’র প্রভাবে বৃষ্টিপাত বাড়লে তাপপ্রবাহ কাটবে।
আজ শনিবার ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়বে সারা দেশের আবহাওয়ায়। ‘মোখা’র পিঠে পরবর্তী ৪৮ কিংবা ৭২ ঘণ্টায় চট্টগ্রামসহ বৃহত্তর উপকূল ও পার্বত্য অঞ্চলে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এতে করে কিছু কিছু নিমাœাঞ্চলে আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া ‘মোখা’র প্রভাবে ১৬ মে পর্যন্ত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিশেষ করে আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশে স্থানভেদে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার আভাস দিয়েছে ভারতের আবহাওয়া বিভাগ।
আবহাওয়া বিভাগের সর্বশেষ বিশেষ বুলেটিনে আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক জানান, মধ্য-বঙ্গোপসাগর ও এর সংলগ্ন দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ উত্তর, উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও এর কাছাকাছি এলাকায় অবস্থান করছে। ‘মোখা’ গতকাল সর্বশেষ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে এক হাজার ৫ কি.মি. দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্র বন্দর থেকে ৯৩৫ কি.মি. দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল।
‘মোখা’ আরও উত্তর, উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হতে পারে। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র কেন্দ্রের ৭৪ কি.মি.’র মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৩০ কি.মি., যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৫০ কি.মি. পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে সব মাছধরার ট্রলার নৌযানকে অবিলম্বে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে।
ভারতের আবহাওয়া ও ঘূর্ণিঝড় বিজ্ঞানী ড. আনন্দ কুমার দাশ ‘মোখা’র সর্বশেষ গতি-প্রকৃতি ও পূর্বাভাসে জানান, দক্ষিণ-পূর্ব ও এর সংলগ্ন মধ্য-বঙ্গোপসাগরে ‘অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে’ পরিণত ‘মোখা’ আরো উত্তর, উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়েছে। বিগত ৬ ঘণ্টায় গতি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে ‘মোখা’ ১৩ কি.মি. বেগে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছিল। এটি কক্সবাজার থেকে ৮৭০ কি.মি. ও মিয়ানমারের সিটুই (সাবেক আকিয়াব) থেকে ৮শ’ কি.মি. দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল।
‘মোখা’ আরও উত্তর, উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর, ঘনীভূত ও শক্তিশালী হয়ে পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরে গতকাল রাতের মধ্যে ‘অত্যধিক প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে’ পরিণত হতে পারে। অবশ্য ১৪ মে রোবরার আঘাতকালে ‘মোখা’ ‘ধতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়’ হিসেবে শক্তি কিছুটা কমতে পারে। ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ আগামীকাল রোববার দুপুর নাগাদ উত্তর মিয়ানমারের সিটুই-এর (সাবেক আকিয়াব বন্দর) কাছে কিয়াকপু এবং কক্সবাজারের মাঝামাঝি দিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করতে পারে। ‘অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়’ আকারে ‘মোখা’র ওই সময়ে বাতাসের গতিবেগ হতে পারে প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৫০ থেকে ১৬০ কি.মি. পর্যন্ত। যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৭৫ কি.মি. উঠতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দায়িত্বরত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ূইয়া বিশেষ বুলেটিনে গতকাল জানান, আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী আগামী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলীয় এলাকা ও পার্বত্য অববাহিকার স্থানসমূহে এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় এলাকার কতিপয় জায়গায় ‘মোখা’র প্রভাবে মাঝারি থেকে ভারী, অতি ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। এ সময়ে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য অববাহিকায় মহুরী, হালদা, কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, বাঁকখালী, নাফ নদীসমূহের পানির সমতল সময়-বিশেষে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে।
কতিপয় নিম্নাঞ্চলে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে :
ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ পরিস্থিতির কারণে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সঙ্কেতের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ‘অ্যালার্ট-২’ জারি করেছে। বন্দর কোড অনুসারে সাইক্লোন স্ট্যান্ডিং কমিটির সভা হয়েছে। বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, ‘মোখা’র সতর্কতা ও প্রস্তুতির সব ব্যবস্থা ধাপে ধাপে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। ছোট লাইটার জাহাজ, কোস্টারগুলোকে কর্ণফুলী নদীর উজানের দিকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। জেটি-বার্থ ও বহিনোঙরে অবস্থানরত জাহাজগুলোকে ইঞ্জিন চালু রাখতে বলা হয়েছে। যাতে তাৎক্ষণিক নিরাপদ স্থানে সরে যায়। আবহাওয়া সতর্ক সঙ্কেত বাড়লেই জাহাজ চলাচল ও পণ্য উঠানামাসহ অপারেশনাল কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হবে। ইতোমধ্যে বন্দরের নিজস্ব জাহাজ নৌযানগুলো নিরাপদে নোঙরে রাখা হয়েছে। সবক’টি স্থাপনার নিরাপত্তা ও সতর্কতা দেখভাল করা হচ্ছে।