প্রতিনিধি ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ , ৫:২৬:৩১ অনলাইন সংস্করণ
মাফরোজা সিদ্দিকা বুশরা সুনামগঞ্জ: ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫১টি বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও জাতীয় পদকপ্রাপ্ত যোদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এস.এম সামছুল ইসলাম এখনও হুইল চেয়ারে চলাচল করে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।
পঙ্গুত্বের সাথে লড়াই করে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন রণাঙ্গনের এই বীর সেনানী। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সলূকাবাদ ইউনিয়নের লামাপাড়া গ্রামের জন্মস্থানে আর ফেরা সম্ভব হয়নি তাঁর।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দেয়া রাজধানী ঢাকার নবাবপুর রোডের মকিম লেন এলাকায় মাত্র দেড় কাটা জায়গার উপর স্থাপিত ৬৩ লালচান বাসাবাড়ীতে স্বপরিবারে বসবাস করে যাচ্ছেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে গ্রাম ছেড়ে ভারতের মেঘালয় প্রদেশের ইকোওয়ান ট্রেনিং সেন্টারে গিয়ে বেইজ কমান্ডার জগৎজ্যোতি দাশ এর নেতৃত্বে ১৫/৫/১৯৭১ ইং তারিখে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন তিনি। প্রশিক্ষণ গ্রহনের পর ৫নং সেক্টর কমান্ডার লেঃ জেনারেল অব: মীর শওকত আলী বীরবিক্রম এর অধীনস্থ বালাট সাবসেক্টর কমান্ডার মেজর এম.এ মোত্তালিব এর নেতৃত্বাধীন বাহিনীতে সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের সুযোগ পান।
কোম্পানী কমান্ডার বীর প্রতীক এনামুল হক চৌধুরী এমপির নেতৃত্বে সদর থানার তৎকালীন বৃহত্তর রঙ্গারচর ইউনিয়নের বৈশারপাড় গ্রামে ১৫ সেপ্টেম্বর পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে একাধিক গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন তিনি।
আশংকাজনক অবস্থায় প্রথমে তাকে শিলং সামরিক হাসপাতাল,২য় বারে গৌহাটি সামরিক হাসপাতাল,তৃতীয়বারে কলকাতার বেরেকপুর সামরিক হাসপাতাল চতুর্থবারে লখনৌ সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয় তাঁকে।
১৯৭২ এর জানুয়ারি মাসে লখনৌ এর কমান্ড সেন্ট্রাল হসপিটালে ৩ জন যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে দেখতে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্দী। এই ৩ জনের মধ্যম ব্যক্তিটিই হচ্ছেন যোদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম সামছুল ইসলাম।
দেশ স্বাধীনের পর বিজয়ীর বেশে মায়ের কোলে সকল বীর সেনানীরা ফিরে আসলেও যোদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম সামছুল ইসলাম এর জায়গা হয় পঙ্গু বিকলাঙ্গ ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একমাত্র আশ্রয়স্থল বিশ্রামাঘারে। সেখানে তার চিকিৎসা চলে। এর আগে ভারত থেকে দেশে ফিরে সম্মিলিত সিএমএইচ হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা গ্রহন করেন। দীর্ঘদিন চিকিৎসা গ্রহনের ধারাবাহিকতায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে খুন করার পর মোশতাক সরকার বিশ্রামাঘারে অনাহার অর্ধাহারে থাকলেও তারা শত শত যোদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের খবর নেয়নি।
পরবর্তীতে এরশাদ সরকার ক্ষমতায় আসলে শুরু হয় তাদের খোজখবর নেওয়া। রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকার তাদেরকে বিশ্রামাঘারে গিয়ে তাদের শারীরিক অবস্থার খোজখবর নিয়ে তাদেরকে সূর্যসেনিক উপাধিতে ভূষিতসহ পূণর্বাসনের ব্যবস্থা করেন।
এসময় হুইল চেয়ারে চলাচল করলেও জীবিকার প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালিত গুলিস্থান নাজ সিনেমাহলে তিনি টিকেট ম্যানাজারের চাকুরী নেন। ইত্যবসরে ঢাকায় গেলে তার সহযোদ্ধা এডভোকেট আলী আমজাদ বড় ভাই,যোদ্ধাহত আব্দুল হাশিম এবং বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরুসহ জেলা সদরের অনেক মুক্তিযোদ্ধারা তাকে দেখে আসতেন।
জাতীয় তালিকা নং ৩২৪,লাল মুক্তিবার্তা নং ০৫০২১০০২৯০,সাধারন গেজেট নং ৭২৩,যোদ্ধাহত গেজেট নং ১১৯৫,সাময়িক সনদপত্র নং ম-০০০০০৩,মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রদত্ত কার্ড নং ০৫৯৮ রেজি: নং ৩৮২,জাতীয় পরিচয়পত্র নং ৮২১ ৭৪১ ৬০৯১ সহ বিভিন্ন সরকারী বিবরণীতে এই যোদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভূক্ত হয়।
সার্বক্ষনিকভাবে হুইল চেয়ারে চলাচলকারী এ গ্রেডে রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতাপ্রাপ্ত এই যোদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক জাতীয় পদকপ্রাপ্ত হন। সর্বশেষ খবরে জানা যায়,এ গ্রেডে সারাদেশে হুইল চেয়ারে চলাচলকারী ১৮ জন যোদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মাত্র ৩ জন জীবিত আছেন। এর মধ্যে সিলেট বিভাগে একমাত্র তিনিই কিংবদন্তী হয়ে কালের সাক্ষী হিসেবে বেঁচে রয়েছেন। ৩১ জানুয়ারি মঙ্গলবার রাতে শহরের ষোলঘর আবাসিক এলাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধা ছালিক আহমদ ও এডভোকেট হুমায়ূন কবীর জাহানুর এর পরিবারবর্গসহ আত্মীয় স্বজনদেরকে শেষবারের মতো দেখতে এসেছেন তিনি।
আকস্মিক খবরে ভাতিজা সাংবাদিক বাউল আল-হেলাল সহকর্মী রাজু আহমেদ রমজানকে নিয়ে তাঁকে দেখতে যান সেখানে। এসময় একান্ত আলাপচারিতায় ঐ মুক্তিযোদ্ধা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন,সর্বশেষ মেট্রোরেল উদ্বোধন থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহবানে গণভবনে আতিথ্য গ্রহনের সুযোগ পান তিনি। এছাড়াও মান্যবর রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আব্দুল হামিদ বছরে কমপক্ষে দুইবার করে তাদেরকে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রীয় দিবসে আমন্ত্রন জানান। তিনি বলেন, “আমরা বঙ্গবন্ধুর আহবাণে জীবনবাজী রেখে দেশকে স্বাধীন করেছি। আর বঙ্গবন্ধুর কন্যা দেশের উন্নয়নের প্রতিটি পদক্ষেপে আমাদেরকে সম্মান দিয়ে সাথে রেখেছেন।
শেখ হাসিনাই একমাত্র নেত্রী যিনি জীবদ্ধশায় ও মরনের পরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সবচেয়ে বেশী মূল্যায়ন করেছেন”।
ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তার ম্যাসেজ কি ? জানতে চাইলে তিনি বলেন,হুববুল ওয়াতান মিনাল ইমান অর্থাৎ দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ। আমি চাই দেশের প্রতিটি মানুষ দেশপ্রেমিক হউক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে উঠুক। দেশের প্রতিটি নাগরিক শিক্ষিত সুনাগরিক হিসেবে বিকশিত হলে এই দেশ আসলেই সোনার বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উচু করে দাড়াবে। সরকারের কাছে তাঁর শেষ প্রত্যাশা কি জানতে চাইলে আফসোস করে এই বীর সেনানী জানান,
প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২ বার লিখিত নির্বাহী আদেশে মাত্র ১০০১ টাকা প্রতীকি মূল্যে এক কাটা ৫৬ অযুতাংশ জায়গায় অবস্থিত ৬৩ লালচান মুকিমলেন এর বাসভবনটি তাঁকে রেজিষ্ট্রি দলিলমূলে বন্দোবস্তসহ হস্তান্তরের জন্য নির্দেশ প্রদান করলেও গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সেগুন বাগিচা এলাকাধীন ১২ তালা ভবনের ৮ তালায় কমিশনারের কার্যালয়ে তাঁর বন্দোবস্ত আবেদনের ফাইলটি আটকে আছে। এখন পর্যন্ত তিনি বন্দোবস্ত দলিল পাননি।
এ ব্যাপারে আবারও গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি। উল্লেখ্য সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নের লামাপাড়া গ্রামের মরহুম এস.এম তাহির মিয়ার পুত্র যোদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এস.এম সামছুল ইসলাম। তিনি তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের পাটানপাড়া গ্রামের মরহুম ফখর উদ্দিন সর্দারের কন্যা ফারজানা ইসলাম জুনুর সাথে বিবাহ বন্দনে আবদ্ধ হন। তাদের একমাত্র কন্যা শামীমা ইসলাম শশী ইডেন কলেজ থেকে ব্যবসা ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্স পাশ করেছে।
সুশিক্ষিত একমাত্র পুত্র এস.এম রায়হান সাকিব বর্তমানে পর্তুগালে আছে। আগামী ৯ ফেব্রæয়ারি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে দেশপ্রেমিক এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বাসস এর সুনামগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক বাউল আল-হেলালের নেতৃত্বাধীন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল জামুকা স্বীকৃত সংগঠন আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সুনামগঞ্জ জেলা শাখা।