• রাজনীতি

    পৃথক নির্বাচন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি

      প্রতিনিধি ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ , ৭:৪৪:৩৬ অনলাইন সংস্করণ

    ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোল’ স্লোগানে জাতীয় হিন্দু সম্মেলন-২০২৩ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

    শনিবার রাজধানীর গুলিস্তানে মহানগর নাট্যমঞ্চে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী সম্মেলনে সারা দেশ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

    সম্মেলনের উদ্বোধক হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সর্ব ভারতীয় সহ-সভাপতি ও ভারতীয় লোকসভার সংসদ সদস্য দিলীপ ঘোষ।

    সম্মেলনে বক্তারা বলেন, ‘দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ভালো নেই। প্রতিনিয়ত খুন, ধর্ষণ, মারধর, ভাঙচুর, লুটপাট, মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুরসহ ধর্মীয়স্থল অপবিত্র করার মতো ঘটনার শিকার হচ্ছে। কোনো কোনো ঘটনায় মামলা হলেও ক্ষতিগ্রস্তরা বিচার পাচ্ছে না। দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছে এ সম্প্রদায়ের লোকজন। ১৯৭১ সালে যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ছিল ২২ শতাংশ, বর্তমানে ৭.৯ শতাংশে নেমে এসেছে। আগামী ৬ বছরে ২.৮ শতাংশ নামবে এবং আগামী ২০ বছরে দেশে হিন্দু সম্প্রদায় শূন্যে নেমে আসবে।’

    সম্মেলনে নেতারা তিনটি দাবি জানিয়ে বলেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য প্রথমত জাতীয় সংসদে সংখ্যালঘুদের আসন সংরক্ষণ, দ্বিতীয়ত পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা এবং তৃতীয় দাবি সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে। এসব দাবি মানা না হলে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

    সম্মেলন উদ্বোধনের আগে সারা দেশ থেকে আসা নেতাদের একটি র‌্যালি গুলিস্তান এলাকা প্রদক্ষিণ করে মহানগর নাট্যমঞ্চে গিয়ে শেষ হয়। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সম্মেলনে অতিথিদের উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হয়।

    সম্মেলন উদ্বোধন শেষে ভারতীয় লোকসভার সংসদ সদস্য দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘আমার অনেক ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশে আসব। সম্মেলনে উপস্থিত থাকব। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কাজের জন্য তা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জানাই। ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে চলতে চায়, চলছিও। আমাদের সমস্যা থাকতেই পারে। তবে নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করব।’

    তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ভারতের বহু পরম আত্মীয় রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, ভারত ও বাংলাদেশ দুটি আলাদা দেশ হলেও, আমাদের হৃদয়টা এক, আত্মাটা এক। আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচারও এক। তাই ভারতে কোনো সমস্যা হলে বাংলাদেশের মানুষ কষ্ট পায়, বাংলাদেশে কোনো সমস্যা হলে ভারতের মানুষ কষ্ট পায়। বাংলাদেশে যখন কোনো দুর্বৃত্ত দ্বারা হিন্দুরা আঘাতপ্রাপ্ত হয়, আমরা ব্যথিত হই। তাতে বাংলাদেশেরও ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা চাই সবাই মিলেমিশে থাকুক। বাংলাদেশ স্বাধীন করতে ভারতের সৈন্যরা জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে। বাংলাদেশিদের ভারতে থাকতে দেওয়া হয়েছে, খাবার-চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে ছিল, আছে এবং আগামীতেও থাকবে।’

    বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের সব মানুষ, সব ধর্মের মানুষ রক্ত দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে। সবার ঐক্যবদ্ধ ত্যাগেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান মিলেমিশে বসবাস করছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণ আমাদের এ বাংলাদেশ। তবে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা প্রতিরোধ করতে হবে, শক্ত হাতে তা বন্ধ করতে হবে। ছোটবেলায় আমরা সবাই সবার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আনন্দ উপভোগ করতাম।  আমাদের শিক্ষা সংস্কৃতি এক এবং অভিন্ন। আমি সব সময় বিশ্বাস করি, মানবতার সেবাই সবচেয়ে পুণ্যের কাজ। কবি নজরুল ইসলামের ভাষায়- গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীমান’।

    অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশে সব সময় আছেন-থাকবেন এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, আমি মানুষে মানুষে পার্থক্য বুঝি না, করি না। সবাই সমান। এদের সুখে-দুখে সব সময় পাশে ছিলাম, আছি এবং যতদিন বেঁচে আছি পাশে থাকব। তবে বলতে চাই, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আজও মাঝে মধ্যে উঁকি দেয়। যার নেপথ্যে আছে নানা রাজনেতিক ও সামাজিক অপশক্তির তৎপরতা। আমাদের সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুব্ধ হয়ে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে আমরা যে উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখি তা আসলে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

    সম্মেলনে হিন্দু নেতাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে সালমা ইসলাম এমপি বলেন, ‘আপনারা যে দাবি সরকারের প্রতি জানিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন হোক আমরাও চাই। আপনাদের এ দাবিগুলো আমরা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে ধরব। দাবিগুলোর কথা জানাব’।

    নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম বলেন, ‘আপনারা সবাই জানেন আমার এলাকা দোহার-নবাবগঞ্জ উপজেলার হিন্দু ভাই-বোনদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কতটা গভীর। আপনাদের প্রতিটি অনুষ্ঠানে আমি অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করি। সুখে-দুখে আপনাদের পাশে থেকে কাজ করি। আজীবন আপনাদের পাশে আছি, থাকব।’

    তিনি বলেন, ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক নেতৃত্ব দেওয়ার বীরত্বগাথার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনী হিসেবে ভারত বিশাল অবদান রেখেছে। ভারতের সৈন্যরা জীবন দিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন। ফলে আমি মনে করি, বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অক্ষুন্ন রাখতে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের ব্যাপক ভূমিকা রাখা উচিত।’

    অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম আরও বলেন, ‘আমি একজন সংসদ সদস্য হিসেবে প্রস্তাব রাখব, ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান যে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, তা কমিয়ে আনতে হবে। বন্ধুত্ব হতে হবে দুদেশের জনগণের মধ্যে। তাহলেই অনেক সমস্যার সমাধান খুব সহজে হয়ে যাবে।’

    বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি বলেন, ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে হামলা হয়েছে, দোষীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা জরুরি। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে আপনারা (সংখ্যালঘু) জীবন দিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন, জয় বাংলা বলে স্লোগান তুলেছেন। দেশটা স্বাধীন করেছেন। সংবিধানে এখনো সাম্প্রদায়িকতার ছাপ আছে। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশকে যদি মানুষের বাংলাদেশ দেখতে চান, বাঙালির বাংলাদেশ দেখতে চান, তাহলে ৭২-এর বঙ্গবন্ধুর সংবিধান বাস্তবায়ন করতে হবে’।

    সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি বলেন, বাংলাদেশ এবং ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি একই সূত্রে গাঁথা। মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান বাংলাদেশ কখনো ভুলবে না। হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যালঘু নয়, তারা এবং আমরা সমান সমান। দুর্বৃত্ত দ্বারা যে বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো ঘটেছে, এর বিচার নিশ্চিত হওয়া জরুরি। মামলায় অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সম্মেলনে উপস্থাপিত যে দাবিগুলো উঠেছে তা বাস্তবায়নে আমাদের কাজ করতে হবে। দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আর যেন দুর্বৃত্তদের হামলা না হয়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সর্বোচ্চ কঠোর হতে হবে।

    বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব অ্যাডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রামানিক বলেন, ‘সরকারের কাছে আমাদের মূলত তিনটি দাবি, জাতীয় সংসদে সংখ্যালঘুদের আসন সংরক্ষণ, পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা এবং সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন। এসব দাবি আমরা বিগত ৩০ বছর যাবৎ বিভিন্ন সময় উপস্থাপন করে আসছি, সরকার আমলে নিচ্ছে না। আমাদের এ দাবিগুলো মেনে না নিলে বৃহত্তর আন্দোলনের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করতে বাধ্য করা হবে।’

    বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের সভাপতি বিধান বিহারী গোস্বামীর সভাপতিত্বে সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন- ভারতীয় সিনিয়র সাংবাদিক তরুণ চক্রবর্তী, জাসদ সহ-সভাপতি শহিদুল ইসলাম, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৫৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আকাশ কুমার ভৌমিক, জাতীয় হিন্দু মহাজোট নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট দীনবন্ধু রায়, সাংগঠনিক সম্পাদক সুশান্ত রায় প্রমুখ।

    আরও খবর

    Sponsered content