প্রতিনিধি ১০ জুন ২০২২ , ২:৩৯:৪১ অনলাইন সংস্করণ
মহানবী (সা.)-কে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য তীব্র হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক। ইসলামবিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য টিভি চ্যানেলগুলো দায়ী অবশেষে চাপে নূপুর শর্মার বিরুদ্ধে মামলা, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের দুই সপ্তাহ পর দেশ-বিদেশের প্রচন্ড চাপে উপায়ান্তর না দেখে অবশেষে মামলা করা হয়েছে ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বরখাস্ত মুখপাত্র নূপুর শর্মার বিরুদ্ধে। সমাজের শান্তি বিনষ্ট, অস্থিতিশীলতা তৈরি এবং বিদ্বেষ ছড়ানোর দায়ে বিজেপির এই নেতা ছাড়াও আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে গতকাল বৃহস্পতিবার দিল্লি পুলিশ এ মামলা দায়ের করেছে।
দেশটির সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি বলছে, বিজেপির সাবেক মুখপাত্র নূপুর শর্মা, একজন সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কয়েকজন ব্যবহারকারী এবং ধর্মীয় বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। বিজেপির বরখাস্ত মুখপাত্র নূপুর শর্মা এবং দলটির দিল্লির গণমাধ্যম শাখার বহিষ্কার হওয়া প্রধান নবীন কুমার জিন্দালের মহানবীকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের পর মুসলিম বিশ্বে— বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর প্রচন্ড সমালোচনা ও কুটনৈতিক চাপে পড়ে। এর ফলে বাধ্য হয়েই পুলিশ এই পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
নূপুর শর্মা উত্তর প্রদেশের জ্ঞানবাপি মসজিদ ইস্যুতে গত মাসের শেষের দিকে টেলিভিশনের এক টকশোতে এবং জিন্দাল টুইটারে নবীকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। তাদের এ মন্তব্যের পর দেশে-বিদেশে প্রচন্ড সমালোচনার মুখে পড়ে ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতৃত্বাধীন নরেন্দ্র মোদির সরকার। ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং টেলিভিশনে প্রায়ই এমন বিতর্কিত মন্তব্য দেখা যায়। এর মাঝেই পুলিশ দেরীতে পদক্ষেপ নেওয়ায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। আর এ পদক্ষেপ এমন এক সময় নেওয়া হলো যখন সউদী আরব, কাতার, কুয়েত, ইরানসহ প্রায় ১৬টি দেশ বিজেপির দুই নেতার মন্তব্যের জেরে ভারতের তীব্র সমালোচনা এবং নিন্দা জানিয়েছে। ক‚টনৈতিক চাপের মুখেই কি ভারত দুই সপ্তাহ পর বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করল, সেই প্রশ্নও করছেন অনেকে।
এনডিটিভি বলছে, দিল্লি পুলিশের বিশেষ সাইবার ইউনিট কারো অভিযোগের ভিত্তিতে, নাকি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ মামলা দায়ের করেছে সেটি এখনও পরিষ্কার নয়। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্বেষমূলক বার্তা এবং সহিংসতার উসকানির বিষয়ে নিয়মিত নজরদারি করা হচ্ছে বলে আশ্বাস দিয়েছে পুলিশ। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ভারতে ক্রমবর্ধমান চরমপন্থা ও ধর্মীয় বিদ্বেষের নিন্দা জানাতে গত কয়েক দিন ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের তলব করে। এর মধ্যে কয়েকটি দেশ মহানবীকে নিয়ে বিজেপি নেতাদের বিতর্কিত মন্তব্যের দায়ে ভারতকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ারও দাবি জানিয়েছে।
পুলিশের দায়েরকৃত মামলায় আসামি হিসেবে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তারা হলেন- বিজেপির দিল্লির গণমাধ্যম শাখার বহিষ্কৃত প্রধান নবীন কুমার জিন্দাল, পিস পার্টির প্রধান মুখপাত্র শাদব চৌহান, সাংবাদিক সাবা নাকভি, হিন্দু মহাসভার পদধারী নেতা শকুন পান্ডে, রাজস্থানের মাওলানা মুফতি নাদিম, আব্দুর রহমান, অনীল কুমার মীনা এবং গুলজার আনসারি। হিন্দু মহাসভার নেতা শকুন পান্ডে, যিনি সামাজিক মাধ্যমে অন্নপূর্ণা মা উপনাম ব্যবহার করেন; তিনি স¤প্রতি ভারতে শুক্রবারের পবিত্র জুমার নামাজে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহবান জানিয়েছিলেন। একই সঙ্গে তিনি দেশটিতে সাধারণ জনগণকে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে সংখ্যালঘুদের গণহত্যার ডাক দিয়েছিলেন। বিতর্কিত এসব আহবানের মাধ্যমে সা¤প্রদায়িক সহিংসতা উসকে দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে দিল্লি পুলিশ।
এছাড়াও অল ইন্ডিয়া মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের (এআইএমআইএম) প্রধান ও এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এবং ঘৃণা ছড়ানোর জন্য পরিচিত ইয়াতি নরসিংহ আনন্দের নামও রয়েছে মামলার অভিযোগে। পুলিশ বলেছে, বিজেপির বরখাস্তক মুখপাত্র নূপুর শর্মা এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আরেকটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। দিল্লি পুলিশের উপকমিশনার কেপিএস মালহোত্রা বলেছেন, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের কয়েকজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই এফআইআর দায়ের হয়েছে। অশান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে অনলাইনে মিথ্যা এবং ভুল তথ্য প্রচারের দায়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করবে দিল্লি পুলিশের সাইবার ইউনিট।
মধ্যপ্রাচ্যে তীব্র হচ্ছে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক : মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের নিন্দায় সরব হয়ে উঠেছে উপসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ। একই সঙ্গে নবী (সা.)কে বিজেপি নেতাদের অবমাননার দায়ে উপসাগরীয় কয়েকটি দেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহŸানও ক্রমবর্ধমান হারে জোরাল হচ্ছে। বুধবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম বøুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপসাগরীয় দেশগুলোতে মহানবীকে অবমাননার প্রতিবাদে টুইটার এবং ফেসবুকে ‘ভারতীয় পণ্য বর্জন করুন’, ‘নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে অবমাননা বন্ধ করুন’ প্রচারণা ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটির মোট বাণিজ্যের এক দশমাংশেরও বেশি হয় উপসাগরীয় দেশগুলোতে।
ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সাবেক মুখপাত্র নূপুর শর্মা গত মাসে এক টেলিভিশন শোতে অংশ নিয়ে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। পরে দলটির নয়াদিল্লি শাখার গণমাধ্যম প্রধান নবীন জিন্দালও নূপুর শর্মার মন্তব্যের সমর্থনে টুইট করেন।
তাদের এ মন্তব্য দেশটির সংখ্যালঘু মুসলিম স¤প্রদায়কে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এমনকি বিজেপির দুই নেতার মন্তব্যের জেরে ভারতের কয়েকটি রাজ্যের মুসলিমরা বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন। এ ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে বাইরের বিশ্বেও।
বিজেপির দুই সদস্যের বিতর্কিত এ মন্তব্যের জেরে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের তলব করে নিন্দা এবং তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। গত আট বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং ভারতীয় শস্য, পোষাক এবং যন্ত্রপাতির বাজার তৈরিতে সম্পর্ক গড়ার পেছনে ব্যয় করেছেন নরেন্দ্র মোদি। এমন পরিস্থিতিতে উপসাগরীয় অঞ্চলে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহবান নরেন্দ্র মোদির জন্য আরো বেশি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতীয় পণ্য বয়কটের আহবান জানালেন ইমরান খান : কুয়েতের পর এবার পাকিস্তান। নূপুর শর্মা বিতর্কে এবার ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দিলেন ইমরান খান। সেই সঙ্গে নয়াদিল্লির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করার জন্য পাকিস্তান সরকারকে দিলেন পরামর্শ। মহানবী (সাঃ) কে নিয়ে মন্তব্য বিতর্কে ভারতের কড়া সমালোচনার পাশাপাশি পাকিস্তানের শাহবাজ শরিফ সরকারকে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি তাহরিকে ইনসাফ পার্টির প্রধান। শাহবাজের সরকারকে আমদানি করা সরকার বলে কটাক্ষ করেন।
ইমরান খান বলেন, ‘ভারতে বসবাসকারী মুসলমানদের সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে উস্কানি ও ঘৃণার রাজনীতি করছে মোদি সরকার।’ অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশনকে ভারতের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপের আহবান জানান প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য ইতোমধ্যে পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ভারতের কড়া সমালোচনা করেছেন।
এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, ‘মহানবী (স.) সম্বন্ধে ভারতের বিজেপি নেত্রীর আঘাতমূলক মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। নরেন্দ্র মোদি অধীনে ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে পদদলিত করা হচ্ছে। নিপীড়িত হচ্ছে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা। বিশ্বের এর প্রতিবাদ করা উচিত।’
এই মন্তব্যে শুধুমাত্র পাকিস্তানের জনগণ নয়, মুসলমানদের ভাবাবেগকে গভীরভাবে আঘাত বলে মনে করছে ইসলামাবাদ। সেই সঙ্গে পাকিস্তানে বসবাসকারী সংখ্যালঘুদের পাশে থাকার বার্তা দেয়া হয়েছে।
ভারতে ইসলাম-বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য টিভি চ্যানেলগুলো দায়ী : মহানবী (সাঃ)-কে নিয়ে বিজেপির দুই মুখপাত্রের বিতর্কিত মন্তব্যে জুনের প্রথম সপ্তাহেই সহিংসতা ছড়ায় কানপুরে। লাগাতার ধরপাকড়ের পরে প্রকাশ্য রাস্তায় সংঘর্ষ থামলেও শহরের বহু এলাকা এখনও থমথমে। এমন পরিস্থিতি তৈরির জন্য ভারতের টিভি চ্যানেলগুলোর একাংশের ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ’কেও বুধবার কাঠগড়ায় তুলেছে এডিটর্স গিল্ড অফ ইন্ডিয়া (ইজিআই)।
রীতিমতো বিবৃতি জারি করে সেসব চ্যানেলের উদ্দেশে গিল্ডের আহবান- ‘দয়া করে আপনারা এবার থামুন। ভিউয়ার বাড়াতে আর নিজেদের মুনাফা কামাতে কানপুরের ওই ঘটনার সময়ে আপনারা যা করেছেন, এবার বোধ হয় নিজেদেরই তা যাচাই করার সময় এসেছে’। বিশেষজ্ঞদের দাবি, নব্বইয়ের দশকে আফ্রিকায় গণনিধন কান্ডে সবচেয়ে বড় উস্কানি ছিল দায়িত্বজ্ঞানহীন মুনাফালোভী ‘রেডিও রোয়ান্ডা’র। কানপুরের ঘটনায় কিছু চ্যানেলের ভ‚মিকা আফ্রিকার কুখ্যাত ওই রেডিও স্টেশনের মতো বলেও এদিন তোপ দেগেছে গিল্ড।
শুধু হিংসায় উস্কানি নয়, কিছু চ্যানেলের দায়িত্বজ্ঞানহীন খবর ও সঞ্চালনার জেরে গোটা দেশেরই অকারণে মুখ পুড়েছে বলে দাবি করে টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর আরো কড়া নজরদারির ডাক গিয়েছে গিল্ড। সংস্থাটির কথায়, যদি ওসব চ্যানেল সাংবদিকতার ন্যূনতম এথিক্স এবং সংবিধানের দেয়া ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতি মেনে চলত, তাহলে হয়তো দেশের পক্ষে সম্মানহানিকর এমন পরিস্থিতি তৈরিই হতো না।
নূপুর শর্মা ও নবীন জিন্দালের মন্তব্যের জেরে ১৬টিরও বেশি ইসলামিক দেশ একযোগে ভারতের নিন্দা করে বয়কটের ডাক দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, এর পেছনে একটা বড় খেলা খেলেছে সোশ্যাল মিডিয়ার পাশাপাশি মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমেরও একাংশ। গিল্ডও কার্যত তাতেই সায় দিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
দলীয় কর্মীদের সংযত ও ধর্মবিদ্বেষমূলক বক্তব্য না রাখার আহবান : দলীয় মুখপাত্র এবং নেতাদের টিভি বিতর্কে যোগ দেওয়াসহ তাদের বক্তব্যের নতুন সীমারেখা নির্ধারণ করেছে ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। অর্থাৎ টেলিভিশনে বিতর্কে অংশ নিতে হলে এবার মুখ খুলতে হবে ভেবেচিন্তে। বিজেপি সূত্র বলছে, এখন থেকে শুধুমাত্র বিজেপির অনুমোদিত মুখপাত্র ও প্যানেলিস্টরা টিভি বিতর্কে অংশ নিতে পারবেন। আর মুখপাত্র ও প্যানেলিস্টদের টিভি বিতর্কে অংশ নেওয়ার দায়িত্ব বা অনুমোদন দেবে ভারতের ক্ষমতাসীন এই দলটির মিডিয়া সেল।
একইসঙ্গে টিভি বিতর্কে অংশ নিয়ে বা অন্য কোথাও বক্তব্য দেওয়ার সময় কোনো ধর্ম, তার প্রতীক বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের সমালোচনা করার বিরুদ্ধে মুখপাত্রদের সতর্ক করা হয়েছে বলেও এনডিটিভিকে জানিয়েছে বিজেপির ওই সূত্র। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, কোনো আলোচনা উত্তপ্ত অবস্থায় গেলেও সেখানে সীমা লঙ্ঘন না করতে বিজেপি প্যানেলিস্টদের নিষেধ করা হয়েছে। নিজেদের ভাষা সংযত রাখতে এবং উত্তেজিত না হওয়ার জন্যও অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দলটির এক সূত্র।
সূত্র : টিওআই, এনডিটিভি।