প্রতিনিধি ১৭ মে ২০২২ , ১১:২৪:৩৪ অনলাইন সংস্করণ
আল-হেলাল,সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি: সুনামগঞ্জে বিপদসীমার উপরে পানি, নিম্নাঞ্চল প্লাবিত, বড় বন্যার আশঙ্কা। টানা ভারি বৃষ্টিপাত ও ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের সুরমা নদীসহ সকল শাখা নদীর পানি বৃদ্ধি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে প্লাবিত হয়েছে জেলার নিম্নাঞ্চল। ১৭ মে মঙ্গলবার সকাল থেকে সুরমা নদীর সুনামগঞ্জ পৌরশহরের ষোলঘর পয়েন্টে দিয়ে বিপদ সীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে বন্যা সতর্কতা জারি করেছে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভারতের মেঘালয়ে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় সুনামগঞ্জের সুরমাসহ সবকটি শাখা নদী ও হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতির সম্ভাবনা রয়েছে। সুনামগঞ্জ শহরের বিভিন্ন নিচু এলাকায়ও পানি প্রবেশ করছে ভোরবেলা থেকে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা, দোয়ারাবাজার ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। একইভাবে প্লাবিত হয়ে পড়েছে ছাতক উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। পাহাড়ি ঢলের কারণে জেলার তাহিরপুর বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। সম্প্রতি জেলায় ১৫টিরও বেশি হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে পানি ঢোকায় তড়িঘড়ি করে ধান কেটে নিয়েছিলেন যেসব কৃষক, তারাও নতুন বিপদের সম্মুখীন। এছাড়া ভারতের আসামে বন্যা পরিস্থিতি এবং মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে ভারী বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় পাহাড়ি ঢলের কারণে বন্যার ঝুঁকি রয়েছে বলে আশঙ্কা আবহাওয়া অধিদপ্তরের। সুনামগঞ্জের তেঘরিয়া এলাকার বাসিন্দা তজু মিয়া বলেন, টানা বৃষ্টির আর পাহাড়ি ঢলে পানি বাড়তে শুরু করেছে। বাড়িঘর ও পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় আসবাবপত্রের ক্ষতি হয়েছে। তাছাড়া রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছে এই এলাকার মানুষ। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বসতভিটা হারানো ছাত্তার আলী বলেন, পাহাড়ি ঢলে আমার সব নিয়ে গেছে। আমার আর কিছুই বাকী থাকেনি। কাম কাজ করে টাকা জমিয়ে একটা ঘর করেছিলাম, কিন্তু আমার কষ্টের ঘরটাও পাহাড়ি ঢলে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। আমি একেবারে অসহায় হয়ে গেলাম। এরকম একটা ঘর কি আর আমি বানাতে পারবো? আমারতো এমন একটা ঘর করার মত ক্ষমতা নাই। এখন আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আল্লাহের কাছে সাহায্য চাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার। সুনামগঞ্জ শহরতলীর ইব্রাহিমপুর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মোঃ এমরান হোসেন বলেন,গরীবের কথা ভাসি হইলেও ফলে। আমরা বারবার বলছি পাহাড়,সমতল ও হাওড় এই তিনে মিলে সুনামগঞ্জ। পাউবো যদি বাঁধ করতেই হয় তাহলে তারা যেন জেলার হাওর অংশে বাঁধ করে। সুনামগঞ্জ সদর থানার সুরমা,জাহাঙ্গীরনগর ও রঙ্গারচর এবং বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নের ধোপাজান চলতি নদীর পাড়ে বাঁধের কোন প্রয়োজন নেই বা ছিলনা। কারণ এই এলাকায় যেমন বোরো ফসলের আবাদ খুব কম তেমনি নদীর দুই পারে বাঁধের কাজ করলে পাহাড়ী ঢলের পানি চারদিকে যেতে পারেনা। বাঁধের কারণে পানি বাধাগ্রস্থ হয়ে ধোপাজান অতিক্রম করে সরাসরি একদিকে সুরমা নদীতে এসে প্রবল শ্রোতধারায় পতিত হয়ে প্রথমেই আঘাত হানে সুনামগঞ্জ পৌরসভা ও শহরতলীর ইব্রাহিমপুর মইনপুর হালুয়ারঘাট বাজারসহ সুরমা পাড়ের দুই তীরের জনবসতি বাজারসহ সরকারী বেসরকারী স্থাপনার উপর। তারপরও সরকারী বরাদ্দ লুটতরাজের উদ্দেশ্যে অপ্রয়োজনীয় বাঁধ দিয়ে বন্যার সৃষ্টি করেছে পাউবো ও পিআইসির লোকজনেরা। বাপ–পুতের পিআইসি দিয়ে সরকারী বরাদ্দ লুটপাটের এ মহোৎসবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সুরমা,জাহাঙ্গীরনগর ও রঙ্গারচর ইউনিয়নের লাখো মানুষ। ১৭ মে মঙ্গলবারের বন্যায় মারাত্মক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় ইব্রাহিমপুরসহ নদীরপাড়ের গ্রামগুলিতে। তিনি বলেন এবারের বন্যায় প্রথম ভিকটিম এই গ্রামের বাসিন্দারা।
সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধার কন্যা মনোয়ারা আলম বন্যা,ধারারগাও নিবাসী স্বাস্থ্য পরিদর্শক আবুল কালাম,নবীনগর নিবাসী মহিবুর রহমান তারা মিয়া বলেন,কয়েকদিন ধরে ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে অবিরাম বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণের কারণে সুনামগঞ্জের নদ নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে সুনামগঞ্জ শহরের নিম্নাঞ্চলের বিভিন্ন রাস্তাঘাট ও বাসাবাড়িতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে অনেকেই বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। সুনামগঞ্জের ষোলঘরস্থ সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং গত ২৪ ঘন্টায় ১০২ মিঃমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। নদীর পানি কূল উপচে নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকা শুরু হয়েছে। এদিকে জেলার ছাতক উপজেলায় সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার ১৫২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ফলে শহরের বিভিন্ন অলিগলি ও বাসাবাড়িতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ষোলঘর, নবীনগর, ধারারগাও, জেলরোড, উত্তর আরপিননগর, তেঘরিয়া ও বড়পাড়া এলাকার সড়ক ও কিছু ঘরবাড়িতে পানি ওঠেছে। শহরতলির সুরমা নদীর উত্তরপাড়ের ইব্রাহিমপুর,মইনপুর,সদরগড়সহ নদীরপাড়ের গ্রামগুলোর ঘরবাড়িতে পানি উঠেছে। এছাড়া সুনামগঞ্জের ছাতক,তাহিরপুর,দিরাই,শাল্লা ও জামালগঞ্জের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গোবিন্দগঞ্জ ছাতক সড়কে পানি ওঠায় ছাতকের সঙ্গে সারাদেশের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে এবং জেলা শহরের সাথে তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার একমাত্র সড়কে পানি উঠে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়েছে।
দোয়ারাবাজার থেকে সাংবাদিক এনামুল কবির (মুন্না), জানান,গত ৭ দিনের অব্যাহত ভারি বর্ষণ ও মেঘালয় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে দেখা দিয়েছে অকাল বন্যা। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বগুলা, বাংলাবাজার, লক্ষীপুর, সুরমা, নরসিংপুর ও দোয়ারা সদরসহ উপজেলার ৯ ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের লাখো মানুষ। উপজেলা সদরের সাথে সবক‘টি ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। তলিয়ে গেছে বন্দেহরি, গোজাউড়া ও নাইন্দার হাওরসহ উপজেলার সকল ফসলের মাঠ। এসব হাওরের অধিকাংশ পাকা ধান ঘরে তুলতে না পারায় আহাজারি থামছেনা প্রান্তিক বর্গাচাষীসহ ভূক্তভোগী কৃষকদের। রাস্তা, মাঠঘাট ও গোচারণভূমি তলিয়ে ষাওয়ায় গবাদিপশু নিয়েও বিপাকে পড়েছেন তারা। ঘরের মেঝেতে হাটুপানি, কোমরপানি থাকায় হাড়ি বসছেনা অনেক বানভাসি পরিবারে। ভেসে গেছে অর্ধশতাধিক পুকুরের মাছ। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়াসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকায় বন্ধ রয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। এদিকে মঙ্গলবার দিনভর উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেবাংশু কুমার সিংহ পর্যবেক্ষণ করেছেন বন্যা উপদ্রুত এলাকাসমুহ। হতদরিদ্র অনেক বন্যার্ত পরিবারকে গবাদিপশুসহ নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তরসহ তাদের মধ্যে শুকনাো খাবার বিতরণ করেন। সাথে ছিলেন উপজলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেওয়ান তানভীর আশরাফী চৌধুরী বাবু, সরমা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হালিম বীরপ্রতীক প্রমুখ। এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেবাংশু কুমার সিংহ জানান, বন্যার্তদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যার্তদের জন্য শুকনো খাবারসহ জরুরি ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হবে। বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনুরোধ জানানো হয়েছে। কৃষকদের নষ্ট হওয়ার উপক্রম ধান গুদামে সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) সুনামগঞ্জ জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো.মাহবুব আলম জানিয়েছেন, গত ২ দিনে নদ নদীগুলোতে পানির চাপ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় সুনামগঞ্জের গজারিয়া নদীর রাবার ড্যামের পাম্প হাউজ নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত আনুমানিক সুনামগঞ্জ জেলার নিম্নাঞ্চলের সড়কের প্রায় ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আবহাওয়া সতর্কীকরণ অধিদপ্তরের উদ্ধৃত্তি দিয়ে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ১৭ মে, দেশের উত্তর ও উত্তর–পূর্বাঞ্চলের সকল প্রধান নদ–নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ পয়েন্টে ৩৫ সেন্টিমিটার এবং কুশিয়ারা নদীর অমলশীদ পয়েন্ট ১৩৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘন্টায় দেশের অভ্যন্তরে ছাতক পয়েন্টে ১৮৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। ঐ সময়ে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৩৬৯ মিলিমিটার, শিলচরে ১২০ মিলিমিটার, পাসিঘাট ৭০ মিলিমিটার, ধুব্রি ৬১ মিলিমিটার এবং শিলং এ ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। আগামী ৪৮ ঘন্টায় উজানে মেঘালয়,আসাম এবং হিমালয় প্রদেশে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার ফলে,আগামী ৪৮ ঘন্টায় সুনামগঞ্জের সুরমা, কুশিয়ারা এবং উত্তর ও উত্তর–পূর্বাঞ্চলের নদ–নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশংকার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন,ভারতের মেঘালয়ে কয়েক দিন ধরে বৃষ্টিপাতের ফলে সুনামগঞ্জের নদ–নদীতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতোমধ্যেই সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। আজ নদ–নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জ ও ভারতের মেঘালয়ে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকায় বন্যা সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগের উপ পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানিয়েছেন গতকয়েক দিনের টানা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় সুনামগঞ্জ সদর,বিশ^ম্ভরপুর,তাহিরপুর,ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় ৫শত হেক্টর বোরো ধান পানিতে নিমর্জ্জিত হয়েছে যার ক্ষতির পরিমান হবে ৫ কোটি টাকা। তবে পানি কমে গেলে ক্ষতির কোন আশংঙ্কা থাকবে না । ইতিমধ্যে বণ্যা পরিস্থিতি নিয়ে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেছেন ইতিমধ্যে বন্যার আগাম সর্তকতার কারণে জেলা উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাাদের নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সরকারের উচ্চমহলে বিষয়টি অবগত করা হয়েছে। বন্যার যেকোন পরিস্থিতিতে সরকারের মাধ্যমে যারা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হবে তাদেরকে ত্রান সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।