• আন্তর্জাতিক

    দফায় দফায় চলছে মুসলিম উচ্ছেদ অভিযান, আসামে মুসলমান হওয়াটাই ‘অপরাধ’!

      প্রতিনিধি ১ অক্টোবর ২০২১ , ৩:২৫:৫৯ অনলাইন সংস্করণ

    পুলিশের গুলিতে নিহত মইনুলের স্ত্রী মমতাজ বেগম আসামে দরং জেলার প্রত্যন্ত ধলপুর গ্রামেই আসাম স

    ভারতের আসাম রাজ্য সরকার দফায় দফায় উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে গত কয়েকমাসে। এই গ্রামের যুবক মইনুল হকের ওপরে বর্বরতার ছবি আর তার মৃত্যুর মর্মান্তিক ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

    প্রথমদিকে বলা হচ্ছিল একটি প্রাচীন শিবমন্দিরকে অনেক বড় আকারে গড়ে তোলার লক্ষ্যে মন্দির সংলগ্ন জমি থেকে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হচ্ছে। এধরনেরই একটি উচ্ছেদ অভিযানের সময়ে ২৩ সেপ্টেম্বর আশ্রয়চ্যুতদের বিক্ষোভে পুলিশ গুলি চালায়। স্থানীয় সাংবাদিকরা পুলিশের গুলিতে অন্তত দুজনের মৃত্যু ও আরও বেশ কয়েকজনের আহত হওয়ার খবর জানান। পরে জানা যায়, সেখানে আসাম সরকার একটি কৃষি খামার গড়ে তোলার জন্য তাদের ভাষায়, জমি দখলমুক্ত করতে তারা অভিযান চালিয়েছে। উচ্ছেদের ফলে ভিটে মাটি হারিয়েছেন স্থানীয় বহু বাসিন্দা।

    ধলপুরের মানুষের সংসার বলতে আপাতত এইটুকুই। সব কিছুই রাখা রয়েছে ভেজা মাটিতে। আগের রাতে মুষলধারে ঝড় বৃষ্টি হয়েছে। জ্যোৎস্না বানু নামের এক গ্রামবাসী বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘কাল রাতে খুব ভয় লাগছিল। খুব ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল টিনের চালটা বোধহয় উড়েই যাবে। বাইরেও বেরনোর উপায় নেই। জলের মধ্যেই বাবা মা বোনেদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলাম সারারাত।’

    ক্লাস নাইনে পড়েন জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্নারা যেখানে আশ্রয় নিয়েছে, তার আশপাশে আরও অনেকগুলো টিনের চালের আস্তানা। একটার ভেতরে দেখলাম খাট পেতে মশারি টাঙিয়ে এক সদ্যজাত শিশুকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। তাদের ওই টিনের চালের নিচে জ্যোৎস্নার মা আনোয়ারা বেগম একটা অ্যালমুনিয়ামের কানা উঁচু থালা থেকে কয়েক মুঠো ভাত চারটে থালায় বেড়ে দিচ্ছিলেন। ‘দ্যাখেন, এই কয় মুঠ ভাত। শুধুই শুকনা ভাত। লবণ, ত্যাল কিসুই নাই। সরকার তো খ্যাদায় দিল, কিন্তু কোনও সাহাইয্য আর করল না,’ বলেন তিনি।

    যেদিকেই চোখ যায়, সেদিকেই শুধু ভাঙা টিন, আলমারি, বাক্স আর বাঁশ পড়ে আছে। যেন একটা ধ্বংসস্তূপ। এর মধ্যেই আবার অনেকে গর্ত করে বাঁশ পুঁতছেন, টিনের চালা বানাচ্ছেন। একজনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কী এমন হয়েছিল যে পুলিশ একেবারে গুলি চালিয়ে দুজনকে মেরে দিল? তার কথায়, ‘প্রথম দুদিন তো কোনও সমস্যা হয়নি। সরকার বলেছিল আমাদের থাকার জায়গা দেবে, আমরা নিজেরাই সরে এসেছিলাম। সেদিন একটা ধর্নায় বসেছিলাম আমরা। বাইরের কেউ ছিল না কিন্তু। সেখানে ছিলেন জেলার এস পি সাহেবও। শান্তি মতই আলোচনা হল। তিনি বললেন তোমরা ঘরে চলে যাও। কজনকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিও, আমি কথা বলে নেব। সেই মতো সবাই চলেও গিয়েছিলাম। হঠাৎই পূব দিক থেকে গুলির আওয়াজ পাই। সেই দিকে যেয়ে দেখি এক গর্ভবতী মহিলার হাতে গুলি লেগেছে। সেই শুরু।’

    শুধু যে গুলি চলার দিন সকালে আলোচনা হয়েছিল সরকার আর গ্রামবাসীদের মধ্যে, তা নয়। বেশ কয়েক মাস ধরেই আলোচনা হচ্ছিল এই উচ্ছেদ আর তার পরের পুনর্বাসন নিয়ে। সরকারের দাবি এই জমি তাদের। গ্রামবাসীরা দখলকারী। তাই তাদের সরে যেতে হবে। ‘কেন এটা সরকারি জমি হবে? আমাদের পূর্বপুরুষরা উচিত দাম দিয়ে এই জমি কিনেছিল। সেই দলিলও আমাদের কাছে আছে,’ বলছিলেন আজিরুন্নেসা নামের এক নারী। ‘সরকার যে বলছে এক প্রাচীন শিবমন্দিরের জমিও আপনারা দখল করে রেখেছিলেন?’, এই প্রশ্নের উত্তরে আজিরুন্নেসা জবাব দেন, ‘ওই শিবমন্দির থেকে আমাদের গ্রাম পাঁচ কী ছয় কিলোমিটার দূরে। আমরা ওদিকে যাইও না। আর যদি মন্দিরের জমি খালি করতে হতো, তাহলে আমাদের ঘর ভাঙল কেন সরকার?’

    গ্রামে ঘুরে সাংবাদিকরা জানতে পেরেছেন যে, ওই মন্দিরের জমি দখল নিয়ে যে বিতর্ক ছিল, তা মিটে গেছে অন্তত চার মাস আগে। মন্দিরটির জমি যে ১০-১২টি পরিবার বেআইনিভাবে দখল করেছিল, তারা সরে গেছে মন্দির এলাকার বাইরে আর এখন মন্দিরের জমি পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে, জানালেন গ্রামবাসীরা। বোঝাই যায় যে, মন্দিরের জমি বেআইনি দখলমুক্ত করার সঙ্গে ধলপুরের উচ্ছেদের কোনও সম্পর্কই নেই। গ্রামের মানুষ আরও বলেন, শুধু যে জমির মালিকানার দলিল তাদের কাছে আছে, তাই নয়। তারা নিয়মিত খাজনাও দিয়ে এসেছেন ২০১৫ সাল পর্যন্ত। তারপরেই এটা সরকারি জমি না ব্যক্তিগত, তা নিয়ে বিতর্ক বাঁধায় আর খাজনা দেন না তারা। তবুও গ্রামবাসীরা সরে যেতে রাজি ছিলেন পুনর্বাসন পেলে।

    গুয়াহাটির কলামিস্ট বৈকুণ্ঠ গোস্বামী বলছিলেন, ‘ওখানে একটা বড় কৃষি ফার্ম করবে সরকার। ভাল কথা। কিন্তু এতগুলো মানুষকে উচ্ছেদ করছে, এই মানুষগুলো যে কোথায় যাবে, তার কোনও পরিকল্পনা নেই সরকারের। আর এই বিষয়টাও ভাবার মতো, শুধু কিন্তু মুসলমান এলাকাগুলোতেই উচ্ছেদ করা হচ্ছে।’ কিন্তু সেই উচ্ছেদ অভিযানে ঠিক কেন গুলি চলল, কেন দুজন গ্রামবাসী নিহত হলেন, তা স্পষ্ট নয়। সরকার বলছে তারা বিচারবিভাগীয় তদন্ত শুরু করেছে। আবার একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল এটাও বলছে, ‘হাজার দশেক লোক জড়ো করে দা সহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করলে কি তারা চুপ করে থাকবে?’

    যে ভিডিওটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, সেই ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখেছেন ধলপুরের বাসিন্দা সামাদ আলি। তিনি বলেন, ‘ওই যে মারা গেছে, মইনুল। ওর হাতে একটা লাঠি ছিল। পুলিশ ওর সামনেই ওর এক ভাতিজাকে মারছিল। যে কোন মানুষেরই মাথা গরম হবে এতে। সে ওই কজন পুলিশকে ধাওয়া করেছিল লাঠি নিয়ে। আমরা চেষ্টা করেছিলাম ওকে আটকাতে। কিন্তু পুলিশ যদি গুলি করে দেয়, সেই ভয়ে আর এগোইনি। তারপরেই তো পুলিশ ওকে ঘিরে নিল। আর চুল দাড়িওয়ালা একজন মানুষ ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল, লাথি মারছিল। শেষে তো ওকে বুকে গুলি করল।’

    স্বামীর বুকে আর পায়ে সেই গুলির চিহ্ন সেদিন রাতে দেখতে পেয়েছিলেন মইনুল হকের স্ত্রী মমতাজ বেগম। ধলপুরের উচ্ছেদ হওয়া মানুষরা সুতা নদীর অন্যপাড়ে যেখানে আশ্রয় নিয়েছেন, সেখানে তাদের ভিটে বাড়ির টিনের চালের নিচে, তারই একেবারে শেষ প্রান্তে সাংবাদিকরা গিয়েছিলেন মইনুল হকের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। ভেতর থেকে একটানা বিলাপ করে কান্নার শব্দ আসছিল। ছেলে হারানো মা আর স্বামী-হারা মমতাজ বেগমকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন আত্মীয় পরিজন, প্রতিবেশীরা। মইনুলের মা বিশেষ কথাই বলতে পারলেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে মমতাজ বেগম বলেন, ‘সেদিন বেলা এগারোটার দিকে শেষবার দেখেছিলাম স্বামীকে। তারপর তো রাতে আবার দেখলাম। ওর বুকে গুলি লেগেছিল, আর পায়ে। ওর ওপরে যেভাবে একটা লোক ঝাঁপিয়েছে, লাথি মেরেছে, ওর শরীরটা নীল হয়ে গিয়েছিল।’

    তাদের ফেলে আসা ভিটে মাটি এখন ট্র্যাক্টর দিয়ে চষে ফেলা হচ্ছে – সেখানে গড়ে উঠবে গরুখুঁটি প্রকল্প। এক বিশালাকার কৃষি খামার হবে এই গরুখুঁটিতে। কৃষি কাজ শেখার জন্য স্থানীয় ভূমিপুত্রদের নিয়োগও করা হয়েছে। ‘ওখানে থাকত মুসলমানরা। তাদের উচ্ছেদ করে দিল। সেখানে যদি কোনও উন্নয়নমূলক প্রকল্প নিত, আপত্তি ছিল না। কিন্তু মুসলমানদের উচ্ছেদ করে যদি ভূমিপুত্রদের সেখানে বসাও, তাহলেই বুঝতে হবে তোমার উদ্দেশ্যটা ভাল না,’ আসাম সরকারের উদ্দেশ্যে বলছিলেন গুয়াহাটির প্রবীণ আইনজীবী ও আসাম সিভিল সোসাইটির কার্যকরী সভাপতি হাফিজ রশিদ চৌধুরি।

    প্রথম যে ছাত্রীটির সঙ্গে কথা হয়েছিল, ফেরার সময় সাংবাদিকদের দেখা হয় তার বাবা মজিদ আলির সঙ্গে। তিনি দেখানোর জন্য নিয়ে এসেছিলেন এনআরসিতে যে তার নাম আছে, সেই কম্পিউটার প্রিন্ট আউট। ‘দেখুন তালিকায় প্রথম নামটাই আমার। আমি বা আমরা গ্রামের কেউ তো এখানকার বাসিন্দা। কেউ বাংলাদেশি নই, কেউই বহিরাগত নই। তবুও সেসবই বলা হচ্ছে আমাদের নামে। আসলে আমাদের দোষ একটাই, এটা আমরা খুব ভাল করে বুঝে গেছি। আমরা মুসলমান। আমাদের দোষ এটাই।’

    সূত্র: বিবিসি বাংলা।

    0Shares

    আরও খবর

    Sponsered content