দীর্ঘ প্রায় ১৮ মাস বন্ধের পর শ্রেণিকক্ষে ফেরার এই আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছিল প্রায় সারা দেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাণ হলো শিক্ষার্থী। তাদের বরণ করে নিতে ছিল নানা আয়োজন। কোথাও কোথাও ছিল গানবাজনা, ঢাকঢোল পিটিয়ে উৎসবের আমেজ। ছিল স্বাস্থ্যবিধি মানার কমবেশি চেষ্টা। মাস্ক পরে, হাত ধুয়ে বা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত হয়ে ভিন্ন এক পরিবেশের মধ্য দিয়ে পুনরায় ক্লাসে ফেরার যাত্রা শুরু হলো।
তবে কেউ কেউ সন্তানকে প্রথম দিন স্কুলে পাঠাননি। আবার অনেকে সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে স্বস্তিতেও থাকতে পারেননি। এ জন্য অনেক স্কুলের সামনেই ছিল অভিভাবকদের ভিড়। অভিভাবকদের এমন ভিড়ে বিপদের আশঙ্কা দেখছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র নাজমুল ইসলাম গতকাল এক অনলাইন বুলেটিনে বলেছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অনীহা সন্তানদের বিপদের কারণ হতে পারে। এ জন্য তিনি অভিভাবকদের দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করার পরামর্শ দেন।
করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি শুরু হয়। বাংলাদেশে এত দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকেনি। অবশ্য এর মধ্যে একাধিকবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সংক্রমণ বিবেচনায় তা কার্যকর করা যায়নি। বন্ধের সময় সরকার বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে অনলাইন ও টিভিতে ক্লাস প্রচার করলেও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, সেগুলো খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না। এর মধ্যে অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রমও চালু করে সরকার। কিন্তু শ্রেণিকক্ষের বিকল্প কোনোটাই হতে পারে না। করোনার সংক্রমণ নিম্নমুখী হওয়ায় ৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় কারিগরি কমিটির পরামর্শে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা গতকাল দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘুরে দেখেছেন, প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ছিল শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস।
গতকাল সকাল সাড়ে সাতটার দিকে রাজধানীর বেইলি রোডে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ফটকের সামনে অভিভাবকেরা সন্তানদের নিয়ে অপেক্ষা করছেন। ক্লাস শুরু হতে তখনো অনেকটা সময় বাকি। মাস্ক-ঢাকা মুখের আড়ালেও ছাত্রীদের চোখে ছিল খুশির ঝিলিক। ফটকের মুখেই দাঁড়িয়ে গল্প করছিল দশম শ্রেণির দুই ছাত্রী নুসরাত জাহান ও তাসফিয়া তাসনীম। এত দিন পর কেমন লাগছে স্কুলে এসে? নুসরাত বলল, ‘জীবনের কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বাসায় খালি বলে, পড় পড়। মোবাইল হাতে নিলেই বলে, মোবাইলই শেষ করল। ক্লাস তো মোবাইলে।’
কাছেই সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া লাবিবা তাবাসসুমকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবা। যাত্রাবাড়ী থেকে এসেছেন। বাবা বললেন, আগে মেয়েকে সকালে ঘুম থেকে ওঠাতে বেশ বেগ পেতে হতো। আজ (গতকাল) হয়নি। তাঁরা জেগে ওঠার আগেই দেখেন, মেয়ে স্কুলের পোশাক পরে বসে আছে। সবকিছু ঝটপট সেরেছে সে।
সকাল পৌনে নয়টায় রাজধানীর ইস্কাটনের বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলে ফটকের সামনে গিয়ে দেখা গেল কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে অভিভাবকেরাও আছেন। গতকাল এই স্কুলে প্রথম ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস ছিল। ফটকের বাইরে কথা হয় অভিভাবক তাহমিদা আফরোজের সঙ্গে। তাঁর মেয়ে আসফিনুর ইসলাম প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। সকাল নয়টায় ক্লাস থাকলেও তিনি ৮টা ৪০ মিনিটেই বাচ্চাকে নিয়ে এসেছেন।
রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় নটর ডেম কলেজ প্রাঙ্গণ ছিল শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাসে ভরা। ছুটির পর সেলফি তুলে, গল্প করে সময় কাটিয়েছে অনেকে। এসব শিক্ষার্থী গত বছর উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হলেও কলেজের শ্রেণিকক্ষে এই প্রথমবার এসেছে।
বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি ইংরেজি মাধ্যম, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খুলেছে। যদিও ইংরেজি মাধ্যমের সব স্কুল গতকাল খোলেনি। আবার যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে, তাদের কেউ কেউ অললাইন ক্লাস এবং সশরীর ক্লাস—উভয় ব্যবস্থাই রেখেছে। ধানমন্ডিতে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ম্যাপল লিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে অনেক বেশি কড়াকড়ি।
যাত্রাবাড়ীর তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা যায় প্রবেশপথে ছাত্রদের সারি। সবার মুখেই মাস্ক। অষ্টম শ্রেণির ছাত্র শফিকুল ইসলাম বলছিল, ‘দেড় বছর ধরে ঘরে থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। সব সময় মনে হতো কবে মাদ্রাসা খুলবে, কবে আবার ক্লাসে যাব। দেড় বছর পর আমার আক্ষেপ শেষ হয়েছে।’
ঢাকার একাধিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকেরা জানালেন, দীর্ঘদিন বিদ্যালয়ের বাইরে থাকায় কিছু কিছু শিক্ষার্থী নিজের রোল নম্বর ও শাখা ভুলে গেছে। আবার দীর্ঘদিন পর বন্ধুদের কাছে পেয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাস করতে গিয়ে কোথাও কোথাও স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হয়েছে।
পুরান ঢাকার গণকটুলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঢুকেই দেখা গেল, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কয়েকজন অভিভাবক এদিক-ওদিক দাঁড়িয়ে আছেন। বিদ্যালয়ে তখন তাঁদের সন্তানের ক্লাস চলছে। বিদ্যালয়ের দোতলায় একটি শ্রেণিকক্ষে গিয়ে দেখা গেল, এক শিক্ষক পাঠদানে ব্যস্ত। শিক্ষার্থীরা সবাই দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে। সবার মুখে মাস্ক।
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পঞ্চম শ্রেণিতে মোট শিক্ষার্থী ৮২ জন। কিন্তু উপস্থিত ছিল ৪২ জন। আর তৃতীয় শ্রেণিতে মোট শিক্ষার্থী ৭০ জন। উপস্থিত ছিল ৩৬ জন। প্রাথমিক বিদ্যালয় হলেও সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। অষ্টম শ্রেণিতে মোট শিক্ষার্থী ৭৭ জন। কিন্তু উপস্থিত ছিল ৫০ জন।
প্রধান শিক্ষক মাহমুদা ইয়াসমিন বলেন, দীর্ঘদিন পর খুলছে এবং করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় হয়তো প্রথম দিন উপস্থিতি এমন হয়ে থাকতে পারে। তবে তাঁরা আশা করছেন, কাল (আজ) সোমবার থেকে উপস্থিতি বাড়বে।
হাজারীবাগ বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও উপস্থিতি তুলনামূলক কম। প্রধান শিক্ষক শেখ মোহাম্মদ ছায়িদ উল্লা বলেন, তাঁরা সব অভিভাবকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করছেন। মনে হচ্ছে, কিছু অভিভাবক এখনো দ্বিধাগ্রস্ত।
নীলক্ষেত হাইস্কুলেও তুলনামূলক কম উপস্থিতি দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের।
অবহেলা হলে কঠোর ব্যবস্থা: শিক্ষামন্ত্রী
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গতকাল আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানায় অবহেলা হলে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজস্ব পোশাক নিয়ে এখনই কড়াকড়ি না করতেও শিক্ষকদের নির্দেশ দেন শিক্ষামন্ত্রী। পরিস্থিতি অনুকূল হলে অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা হতে পারে বলেও জানান তিনি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনও রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সেগুনবাগিচা আইডিয়াল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় চালুর পর উদ্ভূত সমস্যার বিষয়ে দৈনিক তথ্য দিতে বলা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী গতকাল রাত সাড়ে আটটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ঘণ্টাখানেক আগপর্যন্ত ১৫ হাজারের অধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য তাঁরা পেয়েছেন। তাতে সার্বিকভাবে বড় কোনো সমস্যা দেখা যায়নি।
পরে রাতে মাউশির পরিচালক (তদারকি ও মূল্যায়ন শাখা) অধ্যাপক মো. আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে সারা দেশে গড়ে ৭০ শতাংশের মতো ক্লাসে উপস্থিত ছিল। তবে অন্য শ্রেণিতে কিছুটা কম।