প্রতিনিধি ২ জুলাই ২০২১ , ৭:২৮:৫১ অনলাইন সংস্করণ
লেখক: সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ, সংসদ সদস্য, মৌলভীবাজার-২:: বাঙালি জাতিকে আলোর পথ দেখিয়ে যাচ্ছে শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশের বাতিঘর বললে এতটুকু অত্যুক্তি হবে না। রাজনীতিক, গবেষকসহ নানা ক্ষেত্রে দেশের অধিকাংশ দক্ষ জনশক্তি তৈরি হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। গৌরবময় অতীত আর ঐতিহ্যের ধারক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে নয়; যুগ যুগ ধরে জন্ম দিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন ইতিহাসের। সমাজের সর্বস্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা নেতৃত্বের আসনে রয়েছেন। রাজনীতি, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, ক্রীড়া, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতাসহ সর্বত্র ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের ছাত্রছাত্রীরা অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মহান বিদ্যাপীঠের কৃতী শিক্ষার্থী ছিলেন। জাতির সংকট ও দুর্দিনে এ বিশ্ববিদালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী বরাবরই সম্মুখ সারিতে ছিলেন।
দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে অনন্য অবদান। এমন ইতিহাস পৃথিবীর অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার আন্দোলন-সংগ্রাম, ছাত্র-রাজনীতি ও আবেগ-অনুভূতি জড়িত। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি স্পর্শ করেই আমি জাতীয় রাজনীতিতে আসীন হই। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে আমি সিলেট মদনমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছিলাম। একই বছর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমার স্বাভাবিক ছাত্রজীবনে ছেদ পড়ে। আমি এ হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারিনি। তাই শোকে কাতর হয়ে বসে না থেকে প্রতিশোধের স্পৃহায় আমি বঙ্গবন্ধু হতাকাণ্ডের পর ‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’ নামে সশস্ত্র আন্দোলনে জড়িয়ে যাই। আমি সে সংগঠনের একজন কমান্ডার ছিলাম।
প্রতিশোধ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত থাকায় আমার শিক্ষাজীবনের বিরতি ঘটে যায় অনেক। চার বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে ১৯৭৯ সালে দেশে ফিরে আসি। সে বছর ডিসেম্বর মাসে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অনার্স শ্রেণিতে ভর্তি হই। এর পর সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের দুঃশাসনের আমলে ও কঠিন সময়ে ছাত্রলীগের হয়ে ছাত্র রাজনীতিতে আবার সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। অবশ্য ১৯৭৪ সালেই আমি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ছিলাম।
এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি করতে করতেই আমি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হই। তবে আমার রাজনৈতিক জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠের কেন্দ্রীয় ছাত্রছাত্রী সংসদ-ডাকসুর সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হওয়া। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই, ডাকসু ভিপি হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে সম্মান ও ভালোবাসা পাই, তার আবেগীয় মাধুর্য ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
আজও স্মৃতির পাতায় জ্বলজ্বল করছে ১৯৮৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ডাকসু নির্বাচনের ঘটনা। সে নির্বাচনে ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যক্ষ ভোটে তৎকালীন ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে আমি ভিপি নির্বাচিত হই। ডাকসু ভিপি নির্বাচিত হওয়া আমার জীবনের অন্যতম তাৎপর্যময় ঘটনা। শুধু তাই নয়, এটি ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির প্রথম বিজয়। আর ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে দলীয় প্রার্থী হয়ে প্রথম বিজয়।
আমাদের সময় ডাকসু নির্বাচনের সময়টা ছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের তুঙ্গে। ১৯৮৩ সালে জাফর-জয়নাল-কাঞ্চন-দীপালি সাহার রক্তের মধ্য দিয়ে এই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়। সেই আন্দোলন তথা ১০ দফার শিক্ষানীতি আন্দোলনের ধারাবাহিকতার একটা পর্যায়ে স্বৈরাচারী সরকার ডাকসু নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।
ডাকসুতে বিজয়ী হয়ে আমরা ‘শিক্ষা পরিবেশ পরিষদ’-এর নীতিমালা বাস্তবায়ন করে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করি। স্বাধীনতার পর প্রথম সন্ত্রাসীদের হুমকি ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আমরা ডাকসু ভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি উত্তোলন করি। এটি আমার রাজনৈতিক জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। হলের সিট বণ্টন মেধার ভিত্তিতে আমরা নিশ্চিত করি। ২১ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছি। ৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনামলে হলে হলে অবস্থান নেওয়া অছাত্রদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থান নিই। সর্বোপরি আমাদের আন্দোলনের ফসলই ছিল স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। এ আন্দোলনে আমাদের হারাতে হয়েছে সেলিম, দেলোয়ার, বাদল, চুন্নু, মাহফুজ বাবু, বসুনিয়া, আসলাম, ডা. মিলনসহ অনেককে।
ডাকসু নির্বাচনে আমার জয়লাভের পেছনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পূর্ণ প্যানেলে জয়লাভের পেছনে কার্যত তার অবদান ছিল মূল। আর ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিজয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে এক নবজাগরণের সৃষ্টি করে।
ডাকসু নির্বাচনে জয়লাভের পরদিন আমাদের প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠন জাতীয়বাদী ছাত্রদল ছাত্রী মিছিলে জঘন্য হামলা চালায়। ওই দিন তারা ছাত্রনেতা কনককে হত্যা করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি বাংলাদেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, গণতান্ত্রিক চেতনা, অধিকার রক্ষাসহ মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের প্রতীক হিসেবে মনে করি। শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের মনমানসিকতা ও দেশপ্রেম গঠন, মেধাসম্পন্ন নাগরিক, জাতীয় নেতৃত্ব সৃষ্টিসহ সবকিছু এখান থেকেই হয়েছে। সেই ঐতিহ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধরে রাখতে হবে। শুধু বাংলাদেশ নয়; পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সুনামের সঙ্গে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়সহ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। সে ঐতিহ্য ধরে রেখে নতুন লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াই এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বড় চ্যালেঞ্জ।
সাবেক সহসভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু