• কৃষি সংবাদ

    সুনামগঞ্জের হাওরে শংঙ্কা নিয়েই ধান কাটা শুরু, পাকা ধানের মৌ-মৌ গন্ধে ভরে গেছে বিস্তীর্ণ ফসলী মাঠ

      প্রতিনিধি ১৭ এপ্রিল ২০২০ , ২:৫৮:১৩ অনলাইন সংস্করণ

    কুলেন্দু শেখর দাস।। নোভেল করোনা ভাইরাসের আতংক নিয়েই সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধর্মপাশা, দিরাই-শাল্লা ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জ সহ প্রায় উপজেলাতেই দেশী জাত ধানের সাথে বিআর-২৮ ধান কাটা শুরু হয়েছে। করোনা ভাইরাসের আতংক থেকেও বুকভরা আশা নিয়ে সোনালী ধান ঘরে তুলতে ধান কাটতে দেখা গেছে কৃষকদের। বিস্তৃীর্ণ ফসলী মাঠ জুড়ে পাকা-অধাপাকা ধানের মৌ-মৌ গন্ধে ভরে গেছে জেলার সব ক’টি হাওর। তবে আংশিক ধানে চিটা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। করোনা ভাইরাসের আতংক নিয়েও ইতোমধ্যে সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, পাবনা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুরসহ উত্তারাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে ধান কাটার শ্রমিকরা আসতে শুরু করেছেন কৃষকদের বাড়িতে। তবে তুলনামূলক ভাবে শ্রমিক সংকটের কারণে কিছুটা উদ্বিগ্ন রয়েছেন কৃষকরা। চলতি বোরো মওসুমে সুনামগঞ্জের ছোট-বড় ১৫৪ টি হাওরে ২ লাখ ২৪ হাজার ৭১৯ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ ৩২ হাজার ৭৯২ মেট্রিক টন। টাকার অংকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধর্মপাশা, দিরাই-শাল্লা, বিশ^ম্ভর পুর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জসহ ১১ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে-গ্রামে এখন শুরু হয়েছে আংশিক বোরো ফসল কাটা। বছরে একটি মাত্র বোরো ফসলকে ঘিরেই হাওরাঞ্চলের মানুষের যত স্বপ্ন। বহু প্রতিক্ষা ও ত্যাগের পর কৃষকদের বছর জুড়ে থাকা অভাব-অনটন আর জমাট বাঁধা দুঃখ-কষ্ট পেরিয়ে, এবার কিছুটা হলেও সোনাঝরা হাঁসি ফোটেছে তাদের মুখে। বহু প্রত্যাশীত সোনালী ধান ঘরে তুলতে করোনা আতংকের মাঝে কৃষকরা ব্যস্ত ধান কাটতে মাঠে, আর কৃষাণীরা মাড়াইকল দিয়ে ধান শুকানোর জন্য খলা প্রস্তুতের কাজ করছেন। অবহাওয়া অনুকুলে থাকলে আর সপ্তাহ খানেকের মধ্যে পুরোদমে ধান কাটা শুরুর হবে, এসময় সবার ঘরে-ঘরে থাকবে ধান আর ধান। হাজারো স্বপ্নে বিভোর কৃষকরা এখন রাত যাপন করছেন ধান কাটার অধীর আগ্রহে। কিন্তু এত স্বপ্নের মাঝেও তাদের মনে আতঙ্কের কোন কমতি নেই। রোদ উঠলেই হাসি আনন্দের ঝলকে ভরে উঠে কৃষাণ-কৃষাণীর মন। আর মেঘলা আকাশ বা বৃষ্টি হলেই তাদের চেহারাটা হয় ফ্যাকাসে। মেঘলা আকাশ আর আকাশ ফাটার শব্দে তাদের শুরু হয় ছটফটানি ও দৌড়ঝাঁপ। পাহাড়ি ঢল তাদের মনে ভাবনা জাগায় বার-বার। চৈত্রের প্রচন্ড অভাবে দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতির কারনে চরম দুর্দিন কাটিয়েছেন কৃষকরা। কৃষকরা রাত পোহালে ধানী মাঠে গিয়ে সোনালী ধানের ঢেউয়ের দোলায় তাদের প্রাণ জুড়িয়ে ভুলে যান দুর্দিনের কথা। মনের অজান্তেই একটু হলেও মুচকি হাঁসি ফুটে উঠে তাদের মুখে। মনের গভীর থেকে মহান আল্লাহ্র নিকট প্রার্থনা করেন ফসল কাটার ক’টা দিনের জন্য। এখন হাওর জুড়ে যে দিকে চোখ যায় শুধুই ধান আর ধান। এ যেন জীবনানন্দের রূপসী বাংলা। বেশ কয়েক বছর ধরে ফসল হারানো নিঃস্ব কৃষকরা এবার কষ্টে ফলানো ধান গোলায় তোলার স্বপ্ন দেখছেন। পুরোদমে ধান কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদের নেতৃত্বে জেলা প্রশাসন, কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর, পাউবোর সংশ্লিষ্টরা দেখার হাওরে কৃষকের ধানকাটার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। তারা কৃষক ও শ্রমিককে হাওরে নেমে পাকা ধান কাটতে আহŸান জানিয়ে ধান কাটায় নামলে শ্রমিকদের ত্রাণ দেওয়ার ঘোষনাও দিয়েছেন। জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধর্মপাশা, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দিরাই-শাল্লা, জগন্নাথপুর সহ কয়েকটি উপজেলার হাওরে বিআর-২৮ ও দেশী জাতের আংশিক ধান কাটা শুরু হয়েছে। সুনামগঞ্জের হাওরের প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে ১০-১৫ বছর পূর্বে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ভাগে ধান কাটার জন্য আসতো বিশাল শ্রমিক বাহিনী। তারা কৃষকের বাড়িতে এক মাস থেকে ধান কেটে মোটা অংকের পারিশ্রমিক নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। যাওয়ার সময় তাদেরকে গরু-খাসী ও নতুন পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী উপহার দেয়া হতো। এখন আর আগের মতো শ্রমিক না আসায় ধান কাটার জন্য শ্রমিক সংকটে পড়তে হয় কৃষকদের। পাকনা হাওরের কৃষক রফিক মিয়া বলেন, এবার বহু কষ্ঠে দেনা করে ফসল করছি, আল্লার রহমতে ভালো ফলন হইছে ধান কাটা শুরু করছি। কৃষক তোফায়েল আলম চৌধুরী ছানা মিয়া বলেন, সারা বছর কষ্ট করে দেনা করে ফসল ফলাইছি। ফলনও ভালো হইছে কবে আগুল্লিয়ায় চিটাতে ক্ষতি হইছে। কয়েক দিনের মধ্যেই আমার ধান কাটা শুরু হইব, তবে করোনা সংক্রমনের ভয়ে ধান কাটার শ্রমিক পাচ্ছিনা। কৃষক প্রবাল মিয়া বলেন, ধান কাটা শুরু হইছে, আল্লায় যদি কয়েকেটা দিন রোদ দেয় তাইলে হাওরের ফসল ঘরে যাইবো। হালির হাওরের কৃষক আ: রহিম বিআর-২৮ জাতের ধান কেটেছেন, ফলনও হয়েছে ভালো, আর সপ্তাহ খানেক পর হালির হাওরে পুরোদমে ধান কাটা শুরু হবে। জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্রে জানাযায়, সারা জেলায় হাইব্রীড, উফশি ও স্থানীয় জাতের বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। সদর উপজেলায় ১৬ হাজার ১৫০ হেক্টর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় ২২ হাজার ৪৭৫ হেক্টর, দোয়ারাবাজার উপজেলায় ১৩ হাজার ১০০ হেক্টর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় ১১ হাজার ৪৯০ হেক্টর, জগন্নাথপুর উপজেলায় ২০ হাজার ৭২৫ হেক্টর, জামালগঞ্জ উপজেলায় ২৪ হাজার ৬৬০ হেক্টর, তাহিরপুর উপজেলায় ১৮ হাজার ৩০০ হেক্টর, ধর্মপাশা উপজেলায় ৩১ হাজার ৮০০ হেক্টর, ছাতক উপজেলায় ১৪ হাজার ৮০০ হেক্টর, দিরাই উপজেলায় ২৮ হাজার ৯৩০ হেক্টর ও শাল্লা উপজেলায় ২২ হাজার ১০ হেক্টর, মোট ২ লাখ ২৪ হাজার ৪৪০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সফর উদ্দিন বলেন, হাওরের ধান কাটতে শ্রমিক ও কৃষককে প্রতিদিনই উৎসাহিত করছি। ধান কাটতে মাইকিং করা হচ্ছে। ত্রাণের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে ধান কাটার শ্রমিকদের। তাছাড়া বাইরের জেলা থেকে অন্তত ২ হাজার শ্রমিক জেলায় প্রবেশ করেছে। কিছু এলাকায় ধান কাটার মেশিনের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এ সংকট সরকারের একার পক্ষ্যে দ‚র করা সম্ভব নয়। এজন্য এলাকার ধনী কৃষকদের এগিয়ে আসতে হবে। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি ভালো মানের ধান কাটার মেশিন কিনতে পারেন। এতে তারা নিজেরা যেমন উপকৃত হবে পাশাপাশি ছোট ও মাঝারি কৃষকরাও উপকৃত হবেন। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, করোনা ভাইরাস আমাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে ছন্দপতন ঘটিয়েছে। জীবন পরিচালনা আরো কঠিন হয়েছে। আমাদের খাদ্য উদ্ধুত্ত জেলার হাওরে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু শ্রমিক সংকট কৃষকদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এই অবস্থায় কৃষকদের সাহস ও শ্রমিকদের উৎসাহ দিতে হাওরে নেমে সংহতি প্রকাশ করেছি। হাওরের ধান তোলতে পারলে আমাদের কোন অভাব থাকবেনা।

    আরও খবর

    Sponsered content