প্রতিনিধি ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯ , ৪:৪৫:১৭ অনলাইন সংস্করণ
এম এ মোতালিব ভুঁইয়া, স্টাফ রিপোর্টা।। দোয়ারাবাজার উপজেলার হকনগর স্লুইসগেট পানি ব্যবস্থাপনা সমিতির আওতায় এ বছর বোরো চাষাবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ ও স্লুইসগেট পানি ব্যবস্থাপনা সমিতির চরম উদাসীনতার কারণেই এ বছর উপজেলার সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন হাওরের হাজার হাজার হেক্টর বোরো জমি অনাবাদি থাকার সমূহ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে বোরা চারা উৎপাদনের ভর মৌসুমেও পানি পাচ্ছেনা এখানকার কৃষকরা। গত রোববার এলাকাজুড়ে মাইকিং করে ঘোষণা করা হয়- স্লুইসগেটের দ্রুটি জনিত কারণে এ বছর বোরো চাষাবাদে সেচের পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবেনা। সমিতি কতৃপক্ষের এমন ঘোষণায় সীমান্ত এলাকার কৃষকরা এখন চরম হতাশায় ভোগছেন। পানির অভাবে চাষাবাদ ব্যাহত হলে এবার কৃষকের গোলায় বোরো ফসল উঠবেনা বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
খতিয়ে দেখা গেছে, মৌসুম শুরুর পূর্বেই ড্রেন ও বেড়িবাঁধ সংস্কার না করায় মৌলা নদীর উজানের পানি সরবরাহ করে বোরো চাষাবাদ এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। পানি না পেয়ে কৃষকদের বোরো চাষাবাদ ব্যাহত হওয়ায় এ নিয়ে এলজিইডি ও পানি ব্যবস্থাপনা কতৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা গেছে। নানা অজুহাত ও কারণ দেখিয়ে তারা এখন দায়সারা বক্তব্য দিচ্ছেন। অপর দিকে চাষাবাদ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কায় স্বসস্তিতে নেই এখন সীমান্ত এলাকার বোরো চাষিরা।
তবে হকনগর পানি ব্যবস্থাপনা কতৃপক্ষ বলছে, ৬ মাস পূর্বেই ড্রেন সংস্কার ও বেড়িবাঁধ রক্ষায় স্থানীয় এলজিইডি কতৃপক্ষ কে লিখিতভাবে অবহিত করা হলেও এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি সংশ্লিষ্টরা। ফলে এবছর কৃষকদের পানি সরবরাহ আদৌও সম্ভব হবেনা বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে পানি ব্যবস্থাপনা সমিতি।
সরজমিন গিয়ে জানা যায় ২০০৪ সালে সীমান্ত এলাকার কৃষকদের বোরো চাষের আওতায় নিয়ে আসতে স্থানীয় সরকার বিভাগ দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের হকনগর মৌলা নদীতে একটি নান্দনিক স্লুইসগেট নির্মাণ করে। স্লুইসগেটটি নির্মিত হওয়ার পর থেকে বাঁশতলা, কলোনী, জুমগাঁও, পেকপাড়া, মৌলারপাড়, আলমখালী, নতুন বাঁশতলা, চৌধুরীপাড়াসহ অন্তত ৭/৮টি গ্রামের কৃষকরা ওই নদীর পানি দিয়ে বোরো চাষসহ মৌসুমী সবজি চাষ করে থাকেন। আর স্লুইসগেটের আওতায় প্রায় তিন সহ¯্রাধিক উপকারভোগী কৃষকদের মধ্যে নদীর পানি সম বন্টনের জন্য শুরু থেকে ‘হকনগর পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি’ সার্বিক দেকবাল করে আসছে।
সমিতির আওতাভুক্ত বর্তমানে ৪শ’১৪ জন সদস্য রয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী তাদের প্রত্যেককেই প্রতি মাসে ২০ টাকা করে সমিতির তহবিলে জমা দিতে হয়। সমিতি কতৃপক্ষ নিয়মিত সঞ্চয়ের টাকা সদস্যদের নিকট থেকে উত্তোলনও করছেন। সদস্যদের সঞ্চয়ের ওই টাকা হতে উপকারভোগী সদস্যদের মধ্যে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য ঋণ বিতরণ করার নিয়ম থাকলেও প্রকৃত উপকারভোগীরা ঋণ পাচ্ছে না। এ যাবৎ সমিতি প্রায় ৯লাখ টাকা ঋণও বিতরণ করেছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, সমিতির দায়িত্বশীলদের অনেকেই সিন্ডিকেট করে নিজেদের বলয়ে তাদের খেয়াল খুশি মতো ঋণের টাকা বিতরণ করেছেন। ঋণের টাকা উত্তোলনেও সমিতি কতৃপক্ষের গাফিলতির অন্ত নেই। এছাড়া সমিতির কাছে এ যাবৎ কৃষকরা তাদের সঞ্চিত টাকার কোনো হিসাব-নিকাশ পাচ্ছেন না। অধিকন্তু কৃষকরা আজোবধি সমিতি থেকে কোনো লভ্যাংশের মুখ দেখেনি। দীর্ঘদিন ধরেই সমিতির দায়িত্বশীলদের এমন স্বেচ্ছাচারিতা, অব্যবস্থাপনা ও নানা অনিয়ম-দূর্ণীতির কারণে প্রতি বছরই উপকারভোগী কৃষকদের চরম ভোগান্তি এবং সংকটে পড়তে হয়।
হকনগর পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সদস্য অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদক কে বলেন, হকনগর পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি কতৃপক্ষের অনিয়ম ও অবব্যস্থাপনার কারণে সমিতির তহবিলে এখন পর্যন্ত পানি লিজের টাকা সমিতির একাউন্টে জমা হয়নি। ২০১৭ সালে স্লুইসগেটের আওতায় জমি চাষের জন্য পানি সরবরাহে লিজ বাবত ২লাখ ৯৭ হাজার ৫শত টাকা উত্তোলন করা হয়েছে । একই ভাবে ২০১৮ সালে ১লাখ ৫ হাজার টাকা লিজের টাকা উত্তোলন করা হলেও ওই টাকা এখন পর্যন্ত সমিতির তহবিলে জমা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, সমিতির নিয়ম বহির্ভুতভাবে কতৃপক্ষের স্বেচ্ছাচরিতায় তাদেও হাতে কয়েক লাখ টাকা রেখে দিয়েছেন যা সমিতির সভাপতি নিজে ব্যক্তিগত কাজে ওই টাকা ব্যবহার করছেন। সমতিরি সভাপতি সমিতির অন্য সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় না করেই নিজে দুটি প্রকল্পের অধীনে ৮লাখ ২৭ হাজার টাকা ব্যায়ে বেড়িবাঁধে মাটির কাজ করেন। নি¤œমানের কাজ হওয়ার কারণে কিছু দিনের মধ্যেই বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। স্থানীয় উপকারভোগী কৃষকদের অভিযোগ, সমিতির সভাপতি আব্দুল আহাদ প্রভাবশালী হওয়ায় কোনো প্রকারের সমন্বয় না করেই স্বেচ্ছাচারি হয়ে ওঠেছেন। সমিতির কতিপয় অসাধু লোকজন অনিয়মের আশ্রয়ে বছর বছর কৃষকের কাছ থেকে সেচ কর আদায় করে আত্মসাৎ করে নিজেদের পকেট ভারী করছেন বলে একাধিক অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
চৌধুরী পাড়া গ্রামের মজিবুর রহমান মাস্টার বলেন, পানি ব্যবস্থাপনা সমিতির নামে অর্থ লুটপাট হচ্ছে। প্রায় অর্ধ কোটি টাকা ব্যয়ে ডেনেজ নির্মাণ করার পরও কৃষক পানি পাবেনা তা মেনে নেয়া যায়না। এবছর পানি না পেলে আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হবো।
বাঁশতলা গ্রামের কৃষক আব্দুল খালেক বলেন, হকনগর স্লুইসগেটের আওতায় উজানের পানি সরবরাহ করে আমরা বোরো চাষাবাদ করি। এখানকার পানি দিয়েই আমরা প্রতিবছর হাজার মন বোরো ধান উৎপন্ন করি। কিন্তু এবছর আমরা সমিতির সভাপতির গাফিলতির কারণে পানি পাবোনা। এ কারণে কৃষককুল এবার না খেয়ে মরতে হবে।
জুমগাঁও গ্রামের কৃষক ও সাবেক ইউপি সদস্য হাসিব উদ্দিন বলেন, এ বছর আমরা পানি পাবোনা, এর দায়ভার কারা নেবে? পানির অভাবে বোরো চাষাবাদ করতে না পারলে আমাদের পথে বসতে হবে।
সমিতির সদস্য মোস্তফা গাজী জানান, সমিতির শুরু থেকে এ যাবৎ কোনো হিসাব নিকাশ নেই। হিসাব চাইলে সমিতির সভাপতি গড়িমসি করেন। তার নেতৃত্বে সমিতির অর্থ লুটপাটের সিন্ডিকেট গড়ে তোলেছেন।
বাঁশতলা গ্রামের উপকারভোগী কৃষক বুরহান উদ্দিন বলেন, সমিতির দায়িত্বশীলদের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম ও দূর্ণীতির বিরুদ্ধে আমি গত দুই বছর ধরেই কথা বলে আসছি। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। এবছর কৃষকরা পানি পাবেনা তা মেনে নেয়া যায়না।
সমিতির ক্যাশিয়ার রাশিদ বলেন আমি নামে মাত্র ক্যাশিয়ার আমার হাতে ক্যাশ নাই সব সভাপতি জানেন।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ প্রকাশিত বাবুল ডাক্তার জানান, আমার কাছে সমিতির অর্থনৈতিক কোনো হিসাব নিকাশ নেই। সবই সভাপতি জানেন। আর ড্রেন সমস্যা দূরী করণে আমরা স্থানীয় এলজিইডি কতৃপক্ষকে অনেক আগেই অবহিত করেছি। তারা সরজমিন পরিদর্শনও করেছেন। কিন্তু বোরো মৌসুম শুরুর পূর্বে তা সমাধান না করায় চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকদের পানি সরবরাহ করা যাচ্ছেনা।
তবে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম ও দূর্ণীতির অভিযোগ গুলো অস্বীকার করে হকনগর পানি ব্যবস্থাপনা সমিতির সভাপতি আব্দুল আহাদ বলেছেন, প্রায় ১লাখ টাকা আমার হাতে আছে, আর বাকী টাকা সমিতির তহবিলে ব্যাংকে জমা রয়েছে। তিনি আরো বলেন, ড্রেন সমস্যা থাকায় পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছেনা।
সমিতির নানা অনয়িম ও দূর্ণীতির বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মৈত্রেয়ী আচার্য্য বলেন, হকনগর সমিতির অব্যবস্থাপনার ব্যাপারে আমি ইতিপূর্বে অবগত হয়েছি, তবে এর সত্যতা খতিয়ে দেখিনি।
দোয়ারাবাজার উপজেলা এলজিইডি’র উপসহকারী প্রকৌশলী সাদিরুল ইসলাম বলেন, হকনগর স্লুইসগেটের ড্রেন সংস্কারের ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো চাহিদা পাঠানো হয়নি। জুন মাসের পূর্বে চাহিদা প্রেরণ করা হলে হয়তো এর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারতো।