প্রতিনিধি ৪ ডিসেম্বর ২০১৯ , ৯:৩৫:০৭ অনলাইন সংস্করণ
ছবি ও নিউজ সিলেট ভয়েস।
ভাটি বাংলা ডেস্কঃ-
রাত পোহালেই সিলেট আওয়ামী লীগের সম্মেলন। সম্মেলন উপলক্ষে সিলেট নগরী সেজেছে উৎসবের সাজে। নগরজুড়ে লাগানো হয়েছে ব্যানার-ফেস্টুন। সিলেট আওয়ামী লীগের মধ্যে যেন লেগেছে উৎসবের ছোঁয়া। কিন্তু এ উৎসব একজন কিশোরের জীবনে এসেছে অভিশাপ হয়ে। কেড়ে নিয়েছে তাঁর একটি হাত। এমনকি বাম পা-টাও হারানোর পথে।
ওই সম্মেলন কিশোর তৌফিকের জীবনে এক কালো অধ্যায় নিয়ে আসলেও যাদের কারণে তার এমন পরিণতি তাদের পক্ষ থেকে নেই কোন সহযোগিতা। বরং অন্য এক যুবকের মানবিকতায় সে আপাতত বেঁচে আছে, চলছে চিকিৎসা। বলছিলাম- মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের ব্যানার লাগাতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঝলসে যাওয়া ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরের কথা।
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট কিশোরের পুরো নাম তৌফিকুর রহমান। সে বরিশালের কাজি বজলুর রহমানের ছেলে। বুধবার (৪ ডিসেম্বর) বিকালে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ৪র্থ তলার ৫ নং ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় বাম হাত হারিয়ে বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে তৌফিক। পাশেই তার মা লাকি বেগম, বাবা ও ছোট এক ভাই। তৌফিকের বাম হাত অপারেশন করে কনুই পর্যন্ত কেটে ফেলা হয়েছে। বাম পায়েও গুরুতর জখম। তাই ব্যান্ডেজ করা।
কথা হয় তার মায়ের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেলো। সেই ছোট থেকেই তৌফিক বখে যাওয়া। আগে আমরা সিলেটে থাকতাম। মানুষের বাসায় কাজ করে সন্তানদের মানুষ করার চেষ্টা করেছি। পরে গত ২ বছর আগে আমি আমার স্বামীর সাথে ছেলে সন্তান নিয়ে বরিশাল গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। আমরা বরিশাল গেলে তৌফিক আমার সাথে কিছুদিন থেকে সে গত কুরবানির ঈদের আগে বাড়ি থেকে সিলেটে চলে আসে। এরপর অনেক চেষ্টা করেও আর বাড়িতে নিতে পারিনি। কিন্তু হঠাৎ শুনলাম সে হাসপাতালে ভর্তি, তার অবস্থা খারাপ। অন্য রোগীর এক স্বজন আমার ছেলের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ফোন করে জানিয়েছেন। এরপর আমরা সিলেটে এসেছি। এসে শুনী বদর উদ্দিন আহমদ কামরান সাহেবের ব্যানার লাগাতে গিয়ে তার এই অবস্থা।’
মায়ের কথা শেষ হতে না হতেই ঘুম ভাঙ্গে কিশোর তৌফিকের। এবার তার সাথেই কথা হলে জানা যায় বীভৎস এ ঘটনার।
তৌফিক জানায়, সে তার অন্য ২ বন্ধুর সাথে রিকাবিবাজারস্থ কাজী নজরুল অডিটোরিয়ামের পাশে একটি বসা ছিলো। এমন সময় দেখে ৩ জন মানুষ কামরান সাহেবের ব্যানার নিয়ে এসেছে। তারাই ব্যানারগুলো লাগাচ্ছিলো। কেবল একটি ব্যানার লাগানো বাকি। তখন এ ৩ জনের নজর পড়ে তাদের দিকে। তারা ডাক দেয়। তখন তৌসিফ ও তার ২ বন্ধু সেখানে গেলে তারা সড়ক নির্দেশনার খুঁটি দেখিয়ে জিজ্ঞাস করে ব্যানারটি এখানে লাগাতে পারবে কি না। লাগালে টাকা দেয়া হবে বললে রাজি হয় তৌফিক। ব্যানার লাগাতে উঠে এক হাতে ব্যানার বাঁধবে এমন ভেবে বাম হাত দিয়ে একটি তারে ধরে। সাথে সাথে পুরো বাম হাত জুড়ে আগুন লেগে যায়। ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা অনুভব হলেও কেবল বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করা ছাড়া তৌফিকের আর কিছু করার ছিলো না।
কিছুসময় এভাবে কেটে গেলে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন মুক্তি পায় তৌফিক। ততক্ষণে তার শরীরে কোন শক্তি নেই। পড়েই যাচ্ছিলো। কিন্তু একটি লোহার রডের উপর আটকে যায় সে। এমন সময় একজন যুবক খুঁটি বেয়ে উপরে উঠে তাকে ধরেন। প্রথমে তাকে নিজের কাঁধের উপর বসালেও নামাতে পারছিলেন না। ওই যুবক ও তৌফিক দুইজনই নিচে থাকা মানুষগুলোকে সহযোগিতার জন্য বারবার চিৎকার করে বললেও কেউ এগিয়ে আসেনি। বরং সবাই ভিডিও ধারণ করতে ব্যস্ত। এভাবে প্রায় ৩০ মিনিটের উপর সময় কেটে গেলে ফায়ার সার্ভিস এসে মই লাগিয়ে তাকে নিচে নামায়। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে উদ্ধারকারী ওই যুবকও যান সাথে। এখনো তিনিই তার চিকিৎসাবাবদ সকল খরচ বহন করছেন। মাঝেমধ্যে ফলমূল নিয়েও খাওয়াচ্ছেন। কিন্তু ঘটনার পরপর উধাও হয়ে যান তারা, যারা তাকে ব্যানার লাগাতে তুলেছিলেন।
কথা বলার সময়ই হাজির হলেন সাহসী মানবিক ওই যুবক। হাতে ব্যাগের ভিতর কিছু ফলমূল। কথা বলে জানা যায়- তার নাম শাহ আলী আহমেদ। তিনি যুক্তরাজ্য প্রবাসী। দেশেও তার ব্যবসা আছে। একই সাথে তিনি মহানগর যুবলীগ নেতা। নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন অনুসারী।
তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি যখন ঘটে তখন আমরা কয়েকজন দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে দেখি উপর থেকে আগুনের ফুলকি পড়ছে। তাৎক্ষণিক আমি ৯৯৯ নম্বরে ফোন করি। পরে পুলিশের পক্ষ থেকেই তাৎক্ষণিক বিদ্যুৎ বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে বিদ্যুৎ বন্ধ করা হয়। এর পর আমি উপরে উঠে তাকে কাধে বসাই। পরে ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসি। কিন্তু আমার অবাক লাগে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো মোবাইলে ভিডিও করলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। হাসপাতালে নিয়ে আসার পর আমি শুনি সে আমাদের নগর আওয়ামী লীগের শ্রদ্ধেয় সভাপতি কামরান আহমদ সাহেবের ছবি সম্বলিত ব্যানার লাগাতে উঠেই তার এ ঘটনা ঘটে। এ ব্যানারটি মূলত সৌমিত্র ধর পিংকুর পক্ষ থেকে লাগানো হচ্ছিলো।’
এদিকে ঘটনার ৬ দিন কেটে গেলেও মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ডের সাবেক আহ্বায়ক সৌমিত্র দাস পিংকুর দেখা মিলেনি বলে অভিযোগ করেন আহত তৌফিকের বাবা বজলুর রহমান। তিনি বলেন, যার জন্য আমার ছেলের আজ এই দশা তার কোন খোঁজ নেই।
তবে এ ব্যাপারে সিলেট ভয়েসের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ডের সাবেক আহ্বায়ক সৌমিত্র দাস পিংকুর সাথে যোগাযোগ করতে একাধিকবার তাঁর ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এদিকে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের ছবি সম্বলিত ব্যানারটি লাগাতে গিয়ে তৌফিকের জীবনে অন্ধকার নেমে আসলেও বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ২ হাজার টাকা দিয়েই দায় সেরেছেন বলে অভিযোগ। ঘটনার পর বদর উদ্দিন আহমদ কামরান একবার গিয়ে ২ হাজার টাকা এক ডাক্তারের কাছে দিয়ে আসলেও তিনি আর কোন খোঁজ নেননি। ফলমূল কিনে সময়ে সময়ে পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে আসলেও পরে তার কিছুই করেননি বলে অভিযোগ তৌফিকের মা-বাবার।
তৌফিকের মা লাকি বেগম বলেন, ‘আমি আসার আগে কামরান সাহেব একবার এসেছিলেন। তখন তিনি একজন ডাক্তারের কাছে ২ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। পরে ওই ডাক্তার আমি আসার পর ১৪০০ টাকা আমার হাতে দিয়েছেন আর বাকি টাকা তার চিকিৎসার বিভিন্ন জিনিশপত্র কিনেছেন। পরে আমার ছেলে কামরান সাহেবকে ফোনে দিলে তিনি দেখছি, আমি এখন সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত বলে ফোন রেখে দিয়েছেন। এরপর আজ পর্যন্ত আর কোন খোঁজ নেননি।’
আপাতত চিকিৎসা চলছে মানবিক যুবক শাহ আলী’র টাকায় বলে জানালেন তার মা। তিনি বলেন, ওই ভাই (আলী) আমাদের সাহায্য না করলে কোন উপায় থাকতো না। প্রথম ৩ দিনতো আমি ছিলামই না। তখন উনি নিজে উপস্থিত থেকে দেখাশোনা করেছেন।’ তবে শাহ আলী বলেন, আমি মানবিকতার জায়গা থেকে চিকিৎসার খরচটা চালাচ্ছি। আমার সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করছি। কিন্তু তার চিকিৎসার জন্য অনেক ব্যয় প্রয়োজন। তাছাড়া তার হাত কাটার মধ্যদিয়ে যে ক্ষতি হলো সকল কিছু বিবেচনা করে যাদের কাজের জন্য হয়েছে তাদেরকেই এগিয়ে আসা উচিৎ। কারণ ১৫ বছরের একটি কিশোরকে দিয়ে